হাওরে বিলুপ্তির পথে দেশী মাছ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৬:১৯:১৮ অপরাহ্ন
জামালগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জের হাওর এক সময় মাছের রাজ্য হলেও আগের তুলনায় এখন প্রচুর দেশী প্রজাতির মাছ গ্রাম এলাকা ও হাট-বাজারে মিলছেনা। এখন ৩০-৩৫ প্রজাতির দেশী মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বাজার দখল করেছে চাষযোগ্য হাই ব্রিড জাতীয় মাছ। যার কারণে হাই ব্রীড জাতীয় চাষের মাছ খেয়ে মিটাতে হচ্ছে আমিষের চাহিদা। হঠাৎ কিছু দেশী মাছ মিললেও চড়া দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় এক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ মিঠা পানির দেশী সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত। প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া ওই মাছ স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ভৈরবে রপ্তানি করা হত। যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির খাতে ভুমিকা রাখতো। এক যুগ আগেও বহু প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত হাওরে। এখন আর এই সব মাছ সচরাচর চোখে পড়েনা। ফাল্গুন চৈত্র মাসে অবাধে জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন করার মূল কারণেই দেশী মাছ কমে যাচ্ছে। নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বর্ষায় মাছের প্রজনন ব্যপকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়া এ সব কারণে গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০-৩৫ জাতের দেশী মাছের প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তির পথে।
তার মধ্য রয়েছে রানী মাছ, গুতুম, দারকিনা, চাপিলা, চাটুয়া, চাঁন্দা, বড় চান্দা, গোল চান্দা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশী পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, শোল, কাংলা, দারকিনা, মলা, ঢেলা, কানপোনা, রিটা, পিয়ালি, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, কাজলি, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইম, বাগাই, তারা বাইম, কাইক্যা ইত্যাদী। এ সব মাছের জায়গা দখল করেছে হাই ব্রীড পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, সিলভার, কার্গো, মিরর কার্প, ঘ্রাস কার্প, সরপুঁটি ইত্যাদী।
বিভিন্ন এলাকার মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে দাম-দরের অস্থিরতা। এক-দুই বছর আগেও যেখানে তেলাপিয়া ছিলো মধ্যবিত্তের সাধ্যের ভেতরে, সেখানে তেলাপিয়ার দাম এখন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। একই অবস্থা পাঙ্গাসেরও। বাজারে আকারভেদে তেলাপিয়ার কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছরের এমন দিনে তেলাপিয়ার কেজি ছিলো ১২০-১৪০ টাকার মধ্যে। গরিবের মাছ হিসেবে খ্যাত পাঙ্গাশের কেজি গত বছরের এমন দিনে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন পাঙ্গাস ১৮০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সিলভার কাপ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে আকার ভেদে। আর এ জাতীয় মাছেই আমিষের চাহিদা মিটতো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের। কিন্তু দাম বাড়ায় সেটিও এখন অনেকের ভাতের পাতে জুটছে না।বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকে বলেন, তেলাপিয়া-পাঙ্গাসে আমাদের স্বস্তি ছিলো এক বছর আগেও। সেই জায়গাটাতেও এখন চরম অস্বস্তি।
এদিকে, জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহৎ পাকনা হাওর ও হালির হাওর ঘুরে কয়েকজন জেলের সাথে কথা হলে তারা বলেন, এখন আগের মতো মাছ নেই হাওর বা নদীতে। হাওরে পাতানো জাল তুলে হতাশ হতে হয় তাদের। কিছু ছোট পুঁটি, চান্দা, বাইলা, তারা বাইম পাঁচ মিশালী মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছের দেখা নেই। জেলেরা বলেন, সারা দিন হাওরে মাছ মেরে তাদের রোজের পারিশ্রমিক অনেক দিন হয় না। আগে বর্ষার পানিতে হাওরে রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউসসহ অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন কিছু ইছা, ছোট পুঁটি আর চান্দার গুঁড়া কিছু পাঁচমিশালি মাছ ছাড়া তেমন কোন মাছ মিলেনা। এর মধ্যে জলমহাল (বিল) ইজারাদারদের রক্ত চক্ষু ও তাদের দৌরাত্মের কারণে জেলেরা চরম হতাশ হয়ে পড়েন।
জামালগঞ্জ- সাচনাবাজারসহ গ্রামীণ হাট বাজারেও এখন হাইব্রিড মাছের দখলে। বর্ষা ও হেমন্তে জলাশয়ে জেলে ও জলমহালের ইজারাদারা মাছ ধরে এলাকার বাইরের পাইকারদের কাছে বেশী দামে বিক্রির কারণেও মাছের সিজনেও প্রায়ই দেশী মাছ পাওয়া যায়না।জামালগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন, নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বেশ কিছু প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে এ সব বন্ধ করে মাছের প্রজননের জন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থল তৈরী করে এলাকাবাসী সচেতন হলে দেশী মাছ রক্ষার একটা উপায় হতে পারে।