ফুটপাত ছাপিয়ে সড়কেও হকাররা !
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:০০:২৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে হকাররা। পথচারীদের চলাচল বন্ধ করে শুধু ফুটপাত দখলেই ক্ষান্ত দেয়নি তারা। সাম্প্রতিক সময়ে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তায় এখন মূল সড়কের বেশীর ভাগ জায়গা দখল করে দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে হকাররা। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামতেই সিটি করপোরেশরন, হেড পোস্ট অফিসসহ বন্দরবাজারের সড়কগুলো দখলে চলে যায় হকারদের। এতে যানজট লেগেই থেকে ব্যস্ত রাস্তায়।
অবৈধভাবে রাস্তা দখল করে ব্যবসা করলেও হকারদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন ক্রেতা থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারীরা। প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধভাবে হকাররা তেড়ে আসে। এমনকি হাত তুলতেও দ্বিধা করেনা তারা। কিছুদিন আগেও হকাররা মেয়রের অভিযান নিয়ে সংশয়ে থাকলেও এখন অনেকটা নিশ্চিতে ব্যবসা চালাচ্ছে তারা। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে হকাররা।
মঙ্গলবার বিকেলে বন্দরবাজারস্থ নগর ভবনের সামনে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগর ভবনের মূল ফটকে অঘোষিত সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। মূল গেইট বন্ধ করে যাত্রী উঠানামা করছে অটোরিক্সা ড্রাইভাররা। সারিবদ্ধ সিএনজির পাশেই পসরা সাজিয়ে বসে আছেন হকাররা। সবজি ওয়ালা থেকে শুরু করে মাছ সহ নানা পণ্য নিয়ে হকারদের দৌরাত্ম করিম উল্লাহ মার্কেটের বিপরীত অর্থাৎ কালিঘাট যাওয়ার রাস্তার মোড় পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। এদিকে এসব এলাকায় মার্কেটের ব্যবসায়ীরা উপরে অস্থায়ী চটের ছাদ দিয়ে দখল করে আছেন ফুটপাতের অর্ধেক। ফলে এই এলাকায় যানজট সমস্যা এখন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মূল ফটকের মেইন রোডে ড্রেন নির্মাণ কাজ চলছে। এক পাশে নির্মাণ কাজের জন্য যানজট ঠিক এর উল্টো দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে কিনব্রিজের মুখ পর্যন্ত ফুটপাত ও রাস্তার অর্ধেক হকারদের দখলে। একই দৃশ্য সুরমা মার্কেট পয়েন্ট থেকে শুরু করে তালতলা পয়েন্ট পর্যন্ত। বিটিসিএল ভবনের পাশে মূল রাস্তায় ড্রেনের নির্মাণ কাজ চলছে। এর সাথে ঘেষেই ভ্যান নিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছে হকাররা। ঠিক বিপরীতে পাশের্^ও ভ্যান নিয়ে সারিবদ্ধ হকার। এসব এলাকায় হকারদের কারণে মূল রাস্তা সংকুচিত হওয়ায় তীব্র হচ্ছে যানজট সমস্যা। ফলে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাত্রী সাধারণ।
সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, মধুবন মার্কেটের সামন থেকে শুরু করে জেলরোড পর্যন্ত সারিবদ্ধ হকার। এদিকে সিটি পয়েন্ট থেকে শুরু করে জিন্দাবাজার হয়ে একদম চৌহাট্টা পর্যন্ত হকারদের দখলে মূল রাস্তার অর্ধেক। শুধু নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টই নয়, পাড়া-মহল্লায় ছাপিয়ে গেছে হকারদের দৌরাত্ম। ফলে নগরজুড়ে জনভোগান্তি এখন চরমে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর হকার সমস্যা সমাধান করতে এবং ফুটপাত দখল মুক্ত করতে বিগত সময়ে হাকার পুনর্বাসনের যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। নগর ভবনের পেছনে জীর্ণ পাকা ভবন ভেঙ্গে হকারদের জন্য জায়গা করে দেন। এর আগ পর্যন্ত তারা সড়কে ব্যবসা করতেন। হকারদের জন্য এখানে রয়েছে আলাদা শেড। কিন্তু এত ব্যবস্থা থাকার পরও অল্প কয়েকটি দোকান সেখানে বসে। বাকি সব হকার আগের মতোই সড়কে চলে এসেছে। প্রতিদিন তারা সড়কে বসে থাকে তাদের পসরা সাজিয়ে। ফলে হকারদের পুনর্বাসনের জন্য নগরীর লালদীঘির পাড়ে বিশাল হকার্স মার্কেট অনেকটা খালি।
সিসিকের বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বরাবরই নগরীতে যানজট ও হকারমুক্ত রাখতে সোচ্চার ছিলেন। আগামী নভেম্বরে মাসেই তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তবে সিটি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় কিছুটা ঢিল দিয়েছিলেন তিনি। এ সুযোগে আবার নগরীর রাস্তাঘাট চলে গেছে হকারদের দখলে। ফলে নগরীর প্রধান সড়কগুলোয় দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নগরবাসী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আরিফুল হক চৌধুরীর অন্যতম পদক্ষেপ ছিল হকার পুনর্বাসন। সে লক্ষ্যে তিনি নগর ভবনের ঠিক পেছনে নগরীর লালদীঘির পাড়ে বিশাল হকার্স মার্কেটের জন্য জায়গা করে দিয়েছিলেন। অনেকেই সেখানে দোকান বরাদ্দ পেয়ে ব্যবসাও শুরু করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সিলেট সিটি করপোরেশনের রাস্তায় হকার উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা হয়। মেয়র আরিফের নেতৃত্বে প্রায় প্রতিদিন চলা এ অভিযান নগরবাসীর প্রশংসা কুড়ায়। সম্প্রতি সিটি নির্বাচনকালীন নমনীয়তার সুযোগে ফের হকাররা ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত দখল করে বসে।
সরজমিনে দেখা গেছে, নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে ছোট সড়ক ও পাড়া-মহল্লায়ও ছড়িয়ে পড়েছে হকারদের বিস্তৃতি। সিলেট যেন হয়ে উঠেছে হকারময় এক নগরী। প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার থেকে শুরু করে পুরো নগরের ফুটপাত ফের হকারদের দখলে চলে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমানভাবে হকারদের উপস্থিতি চোখে পড়বে।
নগর ভবনের মূল ফটক ঘেষে মিউনিসিপাল মার্কেটের সামনে বসা এক হকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাস্তায় ব্যবসা করা সহজ নয়। কখন পুলিশ অভিযান চালায় ঠিক নাই। তাই পুলিশকে সামান্য দিয়ে ম্যানেজ করে চলতে হয়। পুলিশ সুযোগ না দিলে সড়কে বসে ব্যবসা কি করতে পারতাম। তবে পুলিশ বা সিসিক কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে আমরা ব্যবসা করতে পারবো না।
জিন্দাবাজার পুরনো পেপার হকারশেড এলাকায় রাস্তায় বসে কাপড় বিক্রি করা এক হকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন মোটামুটি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করা যাচ্ছে। মেয়রের অভিযান খুব একটা চোখে পড়ছেনা। আর পুলিশকে নিয়মিত একটা মায়না দিতে হয়।
লালদিঘীর পারস্থ হকার মার্কেটের এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, আমি বয়স্ক মানুষ। তাই যখন তখন দৌড়াতে পারিনা। রাস্তায় ব্যবসা করলে পুলিশকে ম্যানেজ রাখতে হয়। এরপরও মাঝে মাঝে উর্ধ্বতন পুলিশ অভিযানে বের হয় তখন কোনভাবেই রক্ষা পাওয়া যায়না। তাই এখানেই পড়ে আছি।
সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন বলেন, নগরীর ফুটপাত এমনেই দখলে এখন রাস্তার দুপাশ দখলে নিয়েছে হকাররা। সেখানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্দ্বিধায় ব্যবসা করে যাচ্ছে তারা। ফলে একদিকে যেমন যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে পথচারীদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কেটের ব্যবসায়ী ও ক্রেতা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মার্কেটের সামনে ফুটপাত দখল করে রাখায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। হকার উচ্ছেদে মেয়র আরিফের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
সদ্য সমাপ্ত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনেকটা হেসেখেলে মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। মেয়র হিসেবে শপথ নিয়ে বসে থাকলেও এখনো দায়িত্ব নেননি। প্রবাসী হওয়ায় হকারদের জন্য সুবিধা বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার নেতা। তাদের বক্তব্য, আনোয়ারুজ্জামান বেশির ভাগ সময় লন্ডনে থাকবেন, তাদের আর আরিফের মতো কেউ দৌড়াতে পারবেন না। স্মার্ট সিটি করার ঘোষণা দিলেও হকার উচ্ছেদের ব্যাপারে তার বক্তব্য এখনো পরিষ্কার হয়নি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, যতদিন আমার মেয়াদ আছে আমি ততদিন কাজ করে যাব। দায়িত্বে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। নতুন যিনি দায়িত্বে আসছেন, তিনি একই রকম কাজ করবেন আশা করি। মাঝখানে নির্বাচন ছিল, কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ছিল অভিযান, এ সুযোগে হকাররা আবার সড়ক দখল করে নিয়েছে। তবে আমি দায়িত্ব ছাড়ার আগের দিন পর্যন্ত নগরীকে সুন্দর রাখতে যা যা করণীয় করে যাব। এরই মধ্যে অভিযান হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ইলিয়াস শরিফ বলেন, হকার উচ্ছেদে বরাবরই সিটি করপোরেশনকে পুলিশ সহায়তা করছে। আমরাও চাই নগরী সুন্দর থাকুক। পুলিশ সবসময় পাশে থেকে তার দায়িত্ব পালন করবে।