এলপি গ্যাস নিয়ে নৈরাজ্য !
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:০৭:৪৮ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল :
পর পর ৩ মাসে ৩ বার বাড়ানো হয়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। একদিকে সরকারী দাম মানতে পারছেনা বিক্রেতারা। অপরদিকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে সিলিন্ডার। সিলেটে এলপি গ্যাস নিয়ে রীতিমত নৈরাজ্য চলছে। বিক্রেতাদের দাবী এলপিজির পাইকারী মূল্য সরকার নির্ধারিত খুচরা দামের চেয়ে বেশী। ক্রেতা সাধারণের দাবী সরকার দাম বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করলেও মানেনা কেউ। এ নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় লোকসান গুণতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ গত রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দাম বাড়িয়ে এলপিজি সিলিন্ডারের নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। প্রতি কেজি এলপিজির দাম ১০৭ টাকা ১ পয়সা হিসেবে ১২ কেজির সিলিন্ডারের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় ১২৮৪ টাকা, যা আগস্ট মাসে ছিল ১১৪০ টাকা। এর আগের মাসে অর্থাৎ গত জুলাই মাসে ছিল ৯৯৯ টাকা। ১২ কেজি সিলিন্ডার ছাড়াও সাড়ে ৫ কেজি থেকে শুরু করে ৪৫ কেজি পর্যন্ত সব সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত দাম সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কার্যকর হয়।
অপরদিকে অটোগ্যাসের দাম লিটার প্রতি ৫২ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ টাকা ৮৭ পয়সা করা হয়। যা জুলাই মাসে ছিল ৪৬ টাকা ৪৯ পয়সা।
জানা গেছে, নতুন দাম ঘোষণার পরপরই ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকেই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশী দামে বিক্রি শুরু হয় সিলিন্ডার। এ নিয়ে ক্রেতাদের সাথে বিক্রেতাদের বাক-বিতন্ডা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ক্রেতাদেরকে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে সিলিন্ডার গ্যাস। এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে পাইকারীতেও সিলিন্ডার মিলছেন বলে অভিযোগ খুচরা বিক্রেতাদের। একই সাথে চাহিদামতো সিলিন্ডার পাচ্ছেন না বলেও জানান নগরীর একাধিক বিক্রেতা। ফলে একদিকে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের বাজারে বর্তমানে বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, ইনডেক্স, বিএম, লাফস, টোটাল, ওমেরা, নাভানা, জেএমআই, ইউনিভার্সাল ও অরিওন কোম্পানীর এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে। সরকার ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১২৮৪ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে কোম্পানীভেদে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০ থেকে ১৪৫০ টাকা দরে। তবে দাম বাড়ার পর থেকে বাজারে বসুন্ধরা গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে বলে একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। আবার বাসায় পৌঁছিয়ে দেয়া বাবদ নেয়া হচ্ছে আরো ৫০ টাকা। ফলে একটি সিলিন্ডার কিনতে গ্রাহককে ১৫০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির এই সময়ে সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন। এখন নতুন ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে কলোনী-বস্তি সব জায়গায় সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের পিঠ রীতিমত দেয়ালে ঠেকে গেছে।
শনিবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও ১৪০০ টাকার নিচে সিলিন্ডার নেই। কোথাও ১৫০০ টাকায়ও গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। সিলেট নগরী ছাড়াও আশপাশের জেলা, পৌরসভা, উপজেলা ও গ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামের বোঝা টানতে হচ্ছে গ্রাহকদেরকে। সিলিন্ডার গ্যাস নিয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। সেখানে পরিবহন খরচের দোহাই দিয়ে অনেকের কাছ থেকে ১৫৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
নগরীর সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, গত সপ্তাহে শুনলাম সরকার ১৪৪ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করেছে ১২৮৪ টাকা। কিন্তু দোকানে কিনতে গেলে দাম চাইছে ১৪০০ টাকা। সাথে বাসায় পৌঁছিয়ে দিতে হবে তাই সাথে আরো ৫০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে।
নগরীর শেখঘাট এলাকার রশিদ আহমদ জানান, স্ত্রী আর ২ সন্তান নিয়ে ৩ জনের সংসার। ১২ কেজির সিলিন্ডারে চলে ২০ দিন। সাধ-সাধ্যের সমন্বয় করতে গিয়ে লাইনের গ্যাস ছাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে উঠেছি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে সিলিন্ডারের দাম যেভাবে বাড়ছে আমাদের বেচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকার যখন কমায় তখন ৫০ থেকে ৮০ টাকা। আবার যখন বাড়ায় এক লাফে ১০০-২০০ টাকা।
নগরীর বাগবাড়ী এলাকার এক খুচরা সিলিন্ডার বিক্রেতা বলেন, আমি প্রতি সিলিন্ডার কোম্পানীভেদে সর্বনিম্ন ১৩৬০ টাকা করে বিক্রি করছি। তবে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে বাসার দূরত্ব অনুযায়ী ৫০-১০০ টাকা অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে। গত ২ সপ্তাহ থেকে বসুন্ধরা গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। চাহিদার অর্ধেক সিলিন্ডার মিলছেনা। তাই অন্য কোম্পানীর সিলিন্ডারই বেশী বিক্রি করছি।
নগরীর আম্বরখানা, সুবিদবাজার, বাগবাড়ী, মদীনা মার্কেট, শেখঘাট, দক্ষিণ সুরমা এলাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খুচরা ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাইকারী বাজারেই সিলিন্ডার প্রতি ১৩১০-৩০ টাকা ধরে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এর উপর আবার পরিবহন খরচ। এছাড়াও একটা সিলিন্ডারে ১৩০০ টাকা বিনিয়োগ করে আমরা সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৫০ টাকা মুনাফা করে থাকি। যদিও সব ব্যবসায়ীরা সমান নয়। এখন নগরীর আনাচে কানাচে সিলিন্ডারের দোকান খুলে বসেছেন অনেকেই। নিয়মিত বাজার মনিটরিং না থাকায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত দামে সিলিন্ডার বিক্রি করে সকল ব্যবসায়ীদের দুর্নাম করছে।
পেট্রোম্যাক্স যমুনা এলপিজির ডিস্ট্রিবিউটর কামাল এন্টারপ্রাইজের পরিচালক কামাল হোসেন বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে আমরা কোম্পানীর কাছ থেকেই সিলিন্ডার সরবরাহ করতে পারিনা। কারণ কোম্পানীর কাছ থেকে আমাদেরকে পাইকারী কিনতে হয় ১২৮০ টাকা। আমরা সিলিন্ডার প্রতি ২০-৩০ টাকা লাভ করি। পাশাপাশি দোকানে দোকানে সিলিন্ডার পৌছে দেই। ফলে আমাদেরকে ১৩১০-১৩২০ টাকা পাইকারী দরে সিলিন্ডার বিক্রি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার ও কোম্পানীর লোকজন বসে কিভাবে দাম নির্ধারণ করে তারাই সেটা বলতে পারেন। সরকার নির্ধারিত দামে যদি সিলিন্ডার পাইকারী বিক্রি হয়, সেটা খুচরা বাজারে পৌছলে মূল্য আরো বেড়ে যায়। আমরা যে দামে কোম্পানীর কাছ থেকে সিলিন্ডার ক্রয় করছি এর চালান-রসিদ আমাদের হাতে রয়েছে। কেউ চাইলে সেটা দেখতে পারেন।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট জেলার সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম মাসুদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলিন্ডারের দামের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি ভোক্তা অধিকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো। শীঘ্র্ই পাইকারী-খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তাদের সাথে কথা বলে কার্যকর পদক্ষেপ নিবো।