সিসা দূষণে ভয়ংকর ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৫৯:০৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বেশ কয়েক বছর ধরেই মারাত্মক পরিবশে দূষণে ভুগছে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা। এর সঙ্গে উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছে সিসা দূষণ।সম্প্রতি চিকিৎসা সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে’ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে। একই কারণে কমছে শিশুদের আইকিউ, যার ফলে বাড়ছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতার ঝুঁকি।বিশ্বব্যাংকের একদল গবেষক “গ্লোবাল হেলথ বার্ডেন অ্যান্ড কস্ট অব লেড এক্সপোজার ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টস: অ্যা হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইকোনমিক মডেলিং অ্যানালাইসিস” নামের এই গবেষণাটি করেছেন।গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে, সিসা দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
সিসা দূষণের ফলে আর্থিক ক্ষতির হিসেবে এর পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৬৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের ২০১৯ সালের মোটি জিডিপি’র প্রায় ৬-৯% এর সমান।প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে শিশুদের। মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।গবেষকরা বাংলাদেশের ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সিসা দূষণের ফলে দেশটিতে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী বাচ্চারা প্রায় দুই কোটি আইকিউ পয়েন্টস হারাচ্ছে। এতে শিশুদের বুদ্ধির যথাযথ বিকাশ হচ্ছেনা। ফলে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে তাদের যেমন সমস্যা হচ্ছে, তাদের আচরণেও নানা অসংগতি দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও খাবারে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজসহ নানা সমস্যা তৈরি করছে।
এ প্রসঙ্গে ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. প্রিসিলা ওবিল বিবিসিকে বলেন, ‘বাংলাদেশে শিশুদের রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি তাদের মেধার পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। সিসা দূষণের ফলে তাদের আইকিউ কমে যাচ্ছে, যা দেশটির সার্বিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সিসা দূষণ বন্ধে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।’এর আগে, ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত “গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ” প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। কিন্তু নতুন এই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এলো আরও ভয়ঙ্কর তথ্য।নতুন এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রকল্প সমন্বয়ক ড. মাহবুবুর রহমান বিবিসিকে বলেন, ‘সিসা দূষণ রোধে এখনই উপযুক্ত সময়। এই সমস্যাকে সমূলে উৎপাটনের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’
বাংলাদেশে সিসা দূষণের বড় উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাটারি ভাঙা শিল্প, সিসাযুক্ত পেইন্ট, অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল, খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত সিরামিকের পাত্র, ই-বর্জ্য, খেলনা, সার, রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মশলা, প্রসাধনী, চাষ করা মাছের জন্য তৈরি খাবার।সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাটির অংশ হিসেবে খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সিসার উপস্থিতি পরিমাপ করে দেখেছে নিউ-ইয়র্ক ভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘পিওর আর্থ’।এসব নমুনার মধ্যে খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত ধাতব ও প্লাস্টিকের পাত্র, সিরামিক পাত্র, রঙ, শুকনা খাবার, খেলনা, রান্নায় ব্যবহৃত মশলা এবং প্রসাধনী পণ্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪% নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত ৫৯% ধাতব পাত্রে, ৪৪% সিরামিক পাত্রে, ৯% প্লাস্টিকের পাত্রে, ৫৪% পেইন্টে, ১৭% চাল/স্টার্চে, ১৩% খেলনায়, ৭% মশলায় এবং ৬% প্রসাধনীতে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়ে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে গড়ে প্রায় ৬.৮ মাইক্রোগ্রাম সিসা পাওয়া গেছে।তবে একজন মানুষের শরীরে কতটুকু সিসা থাকা নিরাপদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তার সঠিক কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি।