প্রাথমিকে নতুন শিক্ষাক্রম: ১ দিনের প্রশিক্ষণে ৮ মাস পার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪০:৪০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বছরের ৯ মাস পার হতে চললেও এখনো নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর সরাসরি প্রশিক্ষণ পাননি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মাত্র এক দিনের অনলাইন প্রশিক্ষণ নিয়েই ‘কোনো রকম’ পাঠদান চালিয়ে নিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা। বছরের দুই-তৃতীয়াংশ সময় পার হলেও শিক্ষকরা এখনো হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা এর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সরাসরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে।
মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) অধীনে। সংস্থাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, এনজিও পরিচালিত স্কুল এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ডিপিই থেকে জানা গেছে, ১ লাখ ১৫ হাজার সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন ৬ লাখ ৫২ হাজার। তাদের মধ্যে শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৮.৯৬ ভাগ প্রশিক্ষণ সনদও পেয়ে গেছেন। তবে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবাই অনলাইন প্রশিক্ষণ পাননি। এ ছাড়া সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায়ের প্রাথমিকের শিক্ষকই সরাসরি প্রশিক্ষণ পাননি।
জানা গেছে, চলতি বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হয়। এর আগে গত বছরের শেষ সপ্তাহে মাধ্যমিক স্তরের দুই শ্রেণির শিক্ষকদের অনলাইনে এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তপাঠ’ এ প্রশিক্ষণ শুরু করে আরও পরে। এরপর ৯ মাস হতে চলল, এখনো সরাসরি প্রশিক্ষণ দিতে পারেনি ডিপিই। ফলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হচ্ছে শিক্ষকদের।
রাজধানীর অন্তত ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক সরাসরি প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শিক্ষকরা জানান, বছরের শুরুতে মুক্তপাঠে তারা এক দিনের অনলাইন প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। যদিও সেটিকে প্রশিক্ষণ না বলে শিক্ষাক্রমের ধারণাপত্র বলা যায়। এরপর সরাসরি আর কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাজেট বরাদ্দ পাচ্ছেন না বলে তারা প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারছেন না।
তারা আরও জানান, প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদানের অনেক বিষয়ই আয়ত্ত করতে পারেননি। যারা বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন, তারা ফেসবুক, ইউটিউব দেখে দেখে শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান নিজেরা করার চেষ্টা করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রিয়াজ পারভেজ বলেন, আমাদের দেশে আগে বাস্তবায়ন, তারপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ কারণে একটি জেনারেশন ধরা খেয়ে যায়। অনলাইনে মুক্তপাঠে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে শুধু ধারণা নেওয়া যায়। এ থেকে খুব বেশি কিছু শেখার সুযোগ নেই। বিষয়ভিত্তিক সরাসরি প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু তার কিছুই হয়নি।
এদিকে, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে রয়েছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, আমরা মুক্তপাঠের মাধ্যমে অল্প কিছু বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে ধারণা দিতে পেরেছি। তবে বেশিরভাগই মুক্তপাঠে ঢুকে সেই ধারণা নিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে। তবে সরাসরি প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। কবে, কোথায়, কীভাবে হয় তাও জানি না।
মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, কারিকুলামের যে ধরন, তাতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ না দিলে শিক্ষকদের বোঝার কথা নয়। মুক্তপাঠে শুধু কারিকুলামের একটি ধারণা পেয়েছেন শিক্ষকরা, সেটি তো বিস্তারিত প্রশিক্ষণ নয়। দিন শেষে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ভুগছে শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) উত্তম কুমার দাশ বলেন, ডলার সংকটের কারণে জুন মাসে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল বরাদ্দের ৫০ শতাংশ টাকা খরচ করা যাবে। সে কারণে ওই মাসে আমরা শিক্ষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণ দিতে পারিনি। তাই আমরা এখন শুরু করতে যাচ্ছি। এরই মধ্যে পিটিআই, এনসিটিবি, নেপ, ইউআরসি সবাইকে নিয়ে একটি ম্যানুয়াল তৈরি করেছি। সে অনুযায়ী শিক্ষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণ শুরু হবে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। সারা দেশের ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণ দুই মাসের মধ্যে শেষ করতে পারব। এ ছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের আমরা অনলাইন প্রশিক্ষণের আহ্বান জানাব। তারা চাইলে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। সেটা করতে হলে তাদের মতো করে আসতে হবে। জেলাভিত্তিক পিটিআইতে কিছু একটা দিয়ে তারা যদি করতে (প্রশিক্ষণ নিতে) চায়, করতে পারবে। কারণ, সরকারি ৬৫ হাজারের পাশাপাশি বেসরকারি ৫৫ হাজার বিদ্যালয়ের দায়িত্ব সরকার সরাসরি নিতে পারবে না।