সিলেটে স্ট্যাম্প-কোর্ট ফি সংকট চরমে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:০০:৩৪ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : সিলেটের আদালতসমূহে জুডিশিয়াল, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও’র তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু সিলেটই নয়, সুপ্রিমকোর্টসহ সারাদেশের অধস্তন আদালতে এই সংকট বিরাজ করছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় বেশি দামে কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প কিনতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। ব্যবসায়ীদের দাবী সরবরাহ না থাকায় অতিরিক্ত দামে কোর্ট-স্ট্যাম্প কিনতে হচ্ছে তাই কিছুটা বেশী দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
আদালতসমূহে স্ট্যাম্পের সরবরাহ কমে যাওয়ায় একদিকে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে সময়মতো কোর্ট ফি আদালতে দাখিল করতে না পারায় মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। উচ্চ দামে জুডিশিয়াল, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ক্রয়ের কারণে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীদের মামলার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন মামলার বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আদালত প্রাঙ্গনে অনেক ভেন্ডারের কাছে কোর্ট ফি স্ট্যাম্প পাওয়া যাচ্ছে না কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও অতিরিক্ত দামে এসব কিনতে হচ্ছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জজ কোর্টের একাধিক আইনজীবীর সাথে আলাপকালে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে কোর্ট ফি-স্ট্যাম্পের সংকটে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছে বিচারপ্রার্থীরা। ১০ টাকার কোর্ট ফি ১৩ টাকা কিনতে হচ্ছে। ১শ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ১শ’ ১৫ থেকে ১শ’ ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে ১৩০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে শোনা যায়। পাঁচশ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ৬ শত থেকে ৭ শত টাকায় কিনতে হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ মোকদ্দমা, পারিবারিক মোকদ্দমা, সাকসেশন মোকদ্দমায় ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে কোর্ট ফি কিনতে হয়। কিন্তু অনেক সময় ট্রেজারিতে টাকা জমা দিয়েও সময় মতো কোর্ট ফি মিলছে না। এতে করে মামলার কার্যক্রম বিলম্ব হচ্ছে।
সিলেট জজ কোর্টের একটি স্ট্যাম্প ভেন্ডারের জনৈক স্বত্তাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে ১ মাসেও কোর্ট ফি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কোর্ট ফি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা। দীর্ঘদিন টাকা জমা থাকলে কীভাবে চলবে ব্যবসা। অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশি দামে কিনে, একটু বেশি দামে বিক্রয় করছে। তবে অনেকেই কোর্ট ফি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে স্ট্যাম্প ভেন্ডর সমিতি সিলেট জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটে গত কয়েক মাস থেকে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের সংকট চলছে। আমরা অনেকেই না পেয়ে কোর্ট ফি বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। প্রয়োজনের তাগিদে অনেকেই বিভিন্নভাবে কোর্ট ফি সরবরাহ করছেন। আমরা বিক্রি করছিনা বিধায় কে কিভাবে বিক্রি করছে সে তথ্য আমাদের কাছে নেই। অনেকেই বলেছেন তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কোর্ট ফি সংগ্রহ করছেন। তবে আমরা স্ট্যাম্প বিক্রি করছি। বাজারে সংকট থাকায় আমাদেরকে বেশী দামে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে নামমাত্র লাভে আমরা স্ট্যাম্প বিক্রি করছি। আমরা স্ট্যাম্প প্রতি সর্বোচ্চ ৫/১০ টাকার বেশী মুনাফা করছিনা।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সহ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আব্দুল খালিক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত কয়েক মাস থেকে আমরা আইনজীবীরা কোর্ট-ফি সংকটে ভূগছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেজারী চালানে টাকা জমা দেয়ার পর ১০ থেকে ১৫ দিন পর কোর্ট ফি পাচ্ছি। অথচ আগে ১/২ দিনের মধ্যেই কোর্ট ফি পাওয়া যেতো। কোর্ট ফি সংকটের কারণে দেওয়ানী স্বত্ত মামলা নিয়ে আমরা সমস্যায় পড়েছি। এতে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। অনেকেই কোর্ট সরবরাহে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা না করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে অতিরিক্ত দামে কোর্ট ফি ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে নকল কোর্ট ফি ব্যবহারের ঝুঁকিও বাড়ছে।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ইয়াহিয়া চৌধুরী সুহেল দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সারাদেশের ন্যায় সিলেটের আদালতেও কোর্ট ফি-স্ট্যাম্পের তীব্র সংকট চলছে। স্ট্যাম্প ভেন্ডরগুলোতেও কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প মিলছেনা। কেউ কেউ বিভিন্ন সোর্স থেকে সরবরাহ করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছেন। আইনজীবীগণ নিরুপায় হয়ে অতিরিক্ত দামে কোর্ট ফি-স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা জেনেছি গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরকে সংকট সমাধানে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সিলেটের আদালতে এর কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছেনা। বিচার কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোর্ট ফি-স্ট্যাম্পের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গভর্ণরকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গেল সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (বিচার) এস কে.এম. তোফায়েল হাসান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আব্দুর রউফ তালুকদার বরাবর এ চিঠি প্রেরণ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ৩ টি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং দেশের ৬৪ টি জেলার অধস্তন আদালতে প্রতি কার্যদিবসে বিচারপ্রার্থী জনগণের পক্ষে মামলা দায়েরসহ অন্যান্য দরখাস্ত দাখিলের সময় জুডিসিয়াল ও নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সংযুক্ত করতে হয়। আদালতে দাখিলকৃত স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি’র মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেয়ে থাকে। জুডিসিয়াল ও নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প জালিয়াতির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি শনাক্তকরণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড (এসপিসিবিএল), ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট ও পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক এর সমন্বয়ে কিছু স্বল্পমেয়াদী ও কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।
তারই ধারাবাহিকতায় CD UV LED flash light (UV-365nm) ডিভাইস ব্যবহার করে নকল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি সনাক্তকরণের নিমিত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি/সম্পাদকগণ-কে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং অধস্তন আদালতে CD UV LED flash light (UV-365nm) ডিভাইস বিতরণ করে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের গোচরীভূত হয়েছে যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং দেশের ৬৪টি জেলায় স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও এর সংকট বিরাজ করছে। বিচারপ্রার্থীদের বাধ্য হয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে ভেন্ডারদের কাছ থেকে এ সব কিনতে হচ্ছে। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুনামগঞ্জ জজ কোর্টের একটি স্ট্যাম্প ভেন্ডারের পরিচালক বলেন, সুনামগঞ্জেও কোর্ট ফি, স্ট্যাম্পের দীর্ঘদিন ধরে সংকট চলছে। গ্রাহকদের চাহিদা মেটানোর জন্য বেশি দামে স্ট্যাম্প কিনতে হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে বিক্রয়ের সময় দাম বেশি মনে হচ্ছে। আমাদের সেই আগের মতোই ৫/১০ টাকা লাভ থাকে।
তিনি আরও বলেন, কোর্টি ফি, স্ট্যাম্প সরবরাহ বেশি হলে দাম আগের মতো হয়ে যাবে। আমরা কম টাকায় কিনতে পারলে বেশি দাম বিক্রয় করব কেন।
জানা গেছে, সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা জজ আদালতে একটি একশ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও ১০ টাকার স্ট্যাম্প ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ সংকট আরও তীব্র। কোন কোন স্থানে এটি একশ টাকার স্ট্যাম্প দেড়শ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভেন্ডারদের অভিযোগ, ট্রেজারিতে স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও এর চরম সংকট থাকায় ট্রেজারি শাখা থেকে চাহিদামতো স্ট্যাম্প, কার্টিজ পেপার, কোর্ট ফি ও ফলিও এর সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কাগজের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় স্ট্যাম্প ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না। বিদেশ থেকে কাগজ আনার পর এটি গাজীপুর সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা হয়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে তা সারাদেশের ট্রেজারিতে পাঠানো হয়। আইনজীবীগণ ও বিভিন্ন ভেন্ডার মালিকগণ ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে চালান ট্রেজারিতে জমা দিলে ট্রেজারি শাখা ভেন্ডরদের স্ট্যাম্প সরবরাহ করে থাকে। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প সরবরাহ স্বাভাবিক করার অনুরোধের আলোকে শীঘ্র্ই এই সংকট সমাধান হবে বলেও সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।