পথশিশুর বড়ো অংশ মাদকাসক্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ৩:০০:০৩ অপরাহ্ন
বিশ্ব পথশিশু দিবস আজ

জেলা প্রশাসক সিলেটের কার্যালয়ের পাশে দেওয়ালে বসে ড্যান্ডি টানছে এক কিশোর।
মুনশী ইকবাল:
দিন দিন পথশিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে তাদের মধ্যে নেশার মাত্রাও। বাড়িঘর ছাড়া পরিবারহীন এসব শিশু ঘুরে বেড়ায় নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এসব শিশুরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়ছে নানান অপরাধে। বস্তায় ভরে কাগজ আর প্লাস্টিকের বোতল ও টুকরো কুড়িয়ে বিক্রি তাদের মূল পেশা। কিন্তু এ থেকে যা আয় হয় তার বেশিরভাগই চলে যায় নেশায়। ফলে তারা অনেকেই ছিচকে চুরি, ছিনতায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে রাহাজানি ইত্যাদিতে জড়িয়ে যায়। নেশার তাদের মূল উপাদান জুতা জুড়া লাগানোর আটা যা স্থানীয়ভাবে আইকা নামে পরিচিত। পলিথিনের ব্যাগে এই দ্রব্য ভরে তারা ড্যান্ডি নামক নেশা করে থাকে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে এসব পথশিশুর প্রায় চার ভাগের এক ভাগ ধূমপানের পাশাপাশি ১২ শতাংশই মাদক আসক্ত।
সরেজমিন নগরীর জিন্দাবাজার, সুরমা মার্কেট, কোর্ট পয়েন্ট ও ওভার ব্রিজ, ক্বীন ব্রিজের আশপাশ, কাজিরবাজার ব্রিজ, দক্ষিণ সুরমার রেলগেইট, বন্দরবাজার, কোর্ট পয়েন্টের কামরান চত্ত্বর, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, রিকাবীবাজার, মদিনা মার্কেট, টিলাগড়, ওসমানী মেডিকেলসহ বিভিন্ন স্থানে পথশিশুদের পলিথিন হাতে প্রায়ই ঘুরতে দেখা যায়। কাঁধে বস্তা ঝুলিয়ে হাঁটছে আর মাঝেমধ্যে হাতে থাকা পলিথিনে নাকমুখ গুজছে। এর মাধ্যমেই মূলত তারা ড্যান্ডি নামক নেশা সেবন করছে। নেশা বেশি হয়ে গেলে যেখানেই অবস্থান সেখানেই বসে পড়ছে বা ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আর এভাবেই আগামী প্রজন্মের একটা অংশ জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে ফেলছে।
এসব পথ শিশুর বেশিরভাগই পরিবার ছাড়া। কারো বাবা মা নেই, কারো বাবা নেই। অল্প কয়েকজনের মা থাকলেও মায়ের সাথেও যোগাযোগ থাকেনা তেমন। ইচ্ছে হলে বাড়ি যায় নইলে পথে পথে ঘুরে। এরা কেউ এসেছে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে, কাউকে বের করে দেওয়া হয়েছে, কারো বাবা মা মরে যাওয়ায় আপন কোনো আশ্রয় নেই। বাড়ি ঘরহীন এসব শিশুর তাই কোনো পিছুটানও নেই। ফলে বাড়িঘরের খোঁজ থাকলেও বেশিরভাগই বাড়ি ফিরতে চায় না। এক গবেষণায় দেখা গেছে এসব শিশুর ৬৪ শতাংশই ঘরে ফিরতে চায় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ‘পথশিশু জরিপ-২০২২’ এর প্রেক্ষিতে জানা যায়, ফিরে যাওয়ার মতো পরিবার নেই ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ পথশিশুর। জরিপ ফলাফলে বলা হয়, এই শিশুরা পারিবারিক ও সামাজিক বাঁধাসহ বিভিন্ন কারণে পথশিশু হতে বাধ্য হয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে পরিবারে ঠাঁই পায়না ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। পরিবার গ্রহণ করে না ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পরিবারই নেই ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ পথশিশুর। পরিবারে প্রতিকূল পরিবেশ ১২ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর। সামঞ্জস্যপূর্ণ পাবিবারিক পরিবেশ নেই ১১ দশমিক ৯ শতাংশ পথশিশুর। নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ পথশিশু। আর পরিবারে কাজের চাপ রয়েছে ১১ শতাংশ পথশিশুর। আর ঘরে ফিরতে সামাজিক বাধা রয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর।
ভোরে কিংবা গভীর রাতে নগরীর জিন্দাবাজার পয়েন্ট, সুরমা মার্কেট, রেল গেইট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দেওয়াল, ক্বীনব্রিজের পাশের ফুটপাতে সারি সারি শিশু ঘুমিয়ে থাকে। এখানে কথা হয় জব্বার, জেমস, বুলেট নামে তিন শিশুর সাথে। তাদের বাড়ি হবিগঞ্জে। বুলেট জানায় তার বাবা ছিলেন দিন মজুর। একদিন গরুর মাংস খেতে এলাকার এক চেহলামের জিয়াফতে গিয়েছিল। সেখানকার লোকজন তাকে চেয়ার থেকে তুলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। পরে বাড়ি এসে বাবার সাথে গরুর মাংসের জন্য বায়না ধরে, মাংস ছাড়া ভাত খাবে না বলে রাগারাগি করায় বাবা মার দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। পরে সে রাগ করে বাড়ি থেকে সিলেট চলে আসে। এখন সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে যা পায় তা দিয়ে চলে যায়। বুলেট, জেমস, জব্বার তিনজনই জানায় তাদের ভালো খাবার জুটে না তবে ড্যান্ডির ব্যবস্থা হয়ে যায়। ড্যান্ডি হলেই চলে যায় আর কিছু লাগে না। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক দলের মিছিলে যায় এতে পঞ্চাশ-একশো টাকা পায়। কোনোদিন দুইতিনটা মিছিল বা সমাবেশও হয়ে যায়, তখন বিরানি খায়।