ইসরায়েলী আগ্রাসন : ৫ শতাধিক ফিলিস্তিনী নিহত, বাস্তুচ্যুত সোয়া লাখ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ৮:১১:৫৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসরায়েলের সংঘাত তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। চলছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। গাজা ও পশ্চিম তীরে রীতিমতো অনবরত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল বাহিনী। এরপর আবার এক লাখ সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে বড় আকারের আগ্রাসনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশটি। খবর আলজাজিরা।জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সংস্থার মতে, বাড়ি এবং অ্যাপার্টমেন্ট ভবন লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং গোলাবর্ষণের ফলে গাজায় প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
মূলত হামাসের ঘাঁটিগুলো তাদের লক্ষ্য বললেও বাদ যায়নি ব্যাংক, মসজিদ থেকে শুরু করে গাজার প্রধান ইন্টারনেট সরবরাহের কেন্দ্রও। পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরগুলোতেও চালাচ্ছে হামলা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন তার দেশ একটা লম্বা এবং কঠিন যুদ্ধে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।এরই মধ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালান্ত গাজার ওপর ‘সম্পূর্ণ অবরোধ’ আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, সেখানে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধের পাশাপাশি খাদ্য ও জ্বালানি প্রবেশ করতে দেবেনা দেশটি। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালান্ট সোমবার এ ঘোষণা দিয়েছেন।ইসরায়েল গাজাকে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করতে যাচ্ছে উল্লেখ করে ইয়োভ গ্যালান্ত বলেন, সেখানে পুরোপুরিভাবে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে। খাদ্য ও জ্বালানি প্রবেশে বাধা দেওয়া হবে।
তবে আল-জাজিরা জানিয়েছে, ২০০৭ সাল থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে গাজা। শহরটির আকাশপথ, স্থল ও জলপথ আগে থেকেই অবরুদ্ধ। ২০ লাখ মানুষের শহরটির বাসিন্দারা সুপেয় পানি পাচ্ছে না। একই অবস্থা বিদ্যুৎ পরিষেবায়ও। জরুরি ওষুধের সংকটে চিকিৎসকরা অপারেশন করতে পারছে না।ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গাজা উপত্যকার দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার এবং এটি ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত। সীমান্তের বড় অংশ রয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে, বাকিটা মিসরের সঙ্গে। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে এখানে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি।জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার বাসিন্দাদের প্রায় ৮০ শতাংশ আন্তর্জাতিক ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভর করেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রতিদিনকার খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন।
এদিকে, যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া দেওয়া ইসরায়েল নতুন করে আরও সৈন্য নিয়োগ দিচ্ছে। সম্ভাব্য স্থল আক্রমণের জন্যই অতিরিক্ত সৈন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পশ্চিম জেরুজালেমে থাকা আল-জাজিরার সংবাদ দাতা উইলয়েম মার্কস।গাজা উপত্যকা থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত শরণার্থী শিবির জাবালিয়া ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে আকাশ পথে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেখানে থাকা আল-জাজিরার সাংবাদিক জামিলেহ আবু জানন জানান, ইসরায়েলি হামলায় ঘনবসতি ক্যাম্পটিতে অর্ধশতাধিক নিহত হয়েছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিক ইয়ুমনা এলসায়েদ জানান, গাজার পাশে অবস্থিত দুটি শরণার্থী শিবিরকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের হামলায় শাথি শরণার্থী শিবিরের একটি মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে।ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত আট হাজার।হতাহতের বিবরণ দিয়ে আল-জাজিরা বলছে, দুপক্ষের সংঘর্ষে শুধুমাত্র গাজায় অন্তত ৫১০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজার ৭৫০ জন। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ১৬ জন নিহত ও ৮০ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলে অন্তত ৮০০ জন নিহত ও দুই হাজার ২৪৩ জন আহত হয়েছে।
এদিকে, হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের প্রভাব পড়ছে বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ হচ্ছে।
টিভিতে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ (ফিলিস্তিনকে মুক্ত কর) লেখা পোস্টার হাতে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়াচ্ছিলেন এবং ইসরায়েলকে বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
হামাসের হামলা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ :
ঘটনার সময় বেশিরভাগ ইসরায়েলি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। শনিবার দিনটি ছিল ইহুদিদের পবিত্র উৎসবের একটি দিন সাব্বাত ছিল। এই দিনে ইসরায়েলিরা বাড়িতে বসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কেউ কেউ সিনাগগ কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আড্ডা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক রকেটের হামলার মুখোমুখি হন তারা। যা ছিল একপ্রকার নজিরবিহীন হামলা।
অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিনের শহর গাজা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল ইসরায়েল। কিন্তু গত শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। হামাস গাজা থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হামলা কীভাবে চালিয়েছে, তা জানতে স্থানীয় লোকজন ও সশস্ত্র যোদ্ধাদের করা ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।প্রথম প্রথম হামাসের ছোড়া রকেট ইসরায়েলের উন্নত আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু গত শনিবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে হামাসের ছোড়া হাজার হাজার রকেট তা প্রতিহত করতে পারেনি।
হামলার ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা করে অস্ত্র মজুত রাখা হয়েছিল। হামাস বলছে, প্রথম দফার তারা অন্তত ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। তবে ইসরায়েলের দাবি, এই সংখ্যা অর্ধেক।গাজা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুজালেমে রকেট ছোড়া হয়েছিল। এ সময় সাইরেন বাজিয়ে সতর্ক করা হয়। হামলার পর ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। রকেট ছোড়ার পাশাপাশি গাজা সীমান্তে শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা।
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আমির মাখুল বলেছেন, এটি নজিরবিহীন কৌশলগত হামলা। এর অবসান আন্দাজ করা মুশকিল। কারণ উত্তেজনার এমন বৃদ্ধি অস্বাভাবিক প্রকৃতির। এমনকি ফিলিস্তিনি হামলার অবসান হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগত প্রভাব থাকবে। এটি সংঘাতের প্রকৃতি ও মাত্রা বদলে দিতে পারে।