পাহাড়-টিলায় ঝূঁকিপূর্ণ বাস
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ৫:৪৪:২০ অপরাহ্ন
ভারী বৃষ্টিতে ধসে পাহাড়, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার
এমজেএইচ জামিল : সিলেটে কয়েকদিন থেকে অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। শনিবার অথৈ জলে ভাসছিল নগরীর অধিকাংশ এলাকা। এরই মাঝে নতুন যোগ হয়েছে পাহাড়-টিলা ধসে মৃত্যুর আতঙ্ক। ভারী বর্ষণে সিলেটে ধসছে পাহাড়-টিলা, মরছে মানুষ। গত শনিবারও টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটের ৪/৫টি স্থানে টিলাধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে এক শিশুর মৃত্যু মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। অন্যান্য স্থানে পাহাড় ধসে আহত হয়েছেন ১০ জন। এ ছাড়া চলমান টানা বর্ষণে পাহাড়-টিলা ধসে অন্তত ৪/৫টি ঘর ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়-টিলার পাদদেশে অবস্থানরত মানুষের মাঝে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে বিভিন্ন পাহাড়-টিলার পাশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। প্রতি বছর বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে পাহাড়-টিলা ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটার পর স্থানীয় প্রশাসন কিছুটা তৎপর হয়ে ওঠে। এলাকায় মাইকিং করে পাহাড়-টিলার পাশে বসবাস না করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। জেলায় পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনের কোনো পরিসংখ্যানও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।
সেভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপর সেভ দ্য হেরিটেজ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায় সিলেট শহরতলী ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে পাদদেশে অন্তত ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এরপর আর কোনো জরিপ চালানো হয়নি। বর্তমানে এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কারণ টিলা কাটা তো থেমে নেই, উল্টো বাড়ছে। এ বিষয়ে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাসকারীদের নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকেই।
জানা গেছে, সিলেটে প্রায় প্রতি বছর বর্ষাকালে টিলা ও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করা পরিবারগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সিলেট জেলা প্রশাসনের কাছে। ভারী বর্ষণে সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাণহাণির শঙ্কাও বেড়েছে। গত শনিবারই সিলেটের অন্তত ৪টি স্থানে টিলাধসের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছে এক শিশু। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। শনিবার সিলেট সদর উপজেলার খাদিম চা বাগান এলাকায় টিলা ধসে এক শিশু মারা যায়। এ ছাড়া নবীগঞ্জে টিলা ধসে আহত হয়েছেন দশজন। আর জৈন্তাপুর উপজেলায় টিলা ধসে তিনটি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছে নগরের আখালিয়ায়ও। পাঁচ দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। বৃষ্টি হয়েছে রোববারও। ফলে বেড়েছে টিলা ধসের শঙ্কাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল বছরের জুন মাসে জৈন্তাপুরের চিকনাগুলে একই পরিবারের ৪ জন পাহাড় চাপায় মারা যান। সেই সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জে পাহাড় ধসে ১০টি পরিবারের ঘর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এমন পরিস্থিতি শুধু সিলেট সদরের চা বাগান, কিংবা জৈন্তাপুর-ফেঞ্চুগঞ্জ নয়। গোটা সিলেট বিভাগে পাহাড়-টিলার নিচে বসবাসকারী সব মানুষই রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে। বিভাগে পাহাড়ের পাদদেশে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে তারা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হলেও কেউ শুনছে না সে কথা। এজন্য সিলেটে পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
জানা গেছে, টিলার পাদদেশে কত মানুষের বাস সিলেটে, সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই, তবে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার টিলার পাদদেশে বসবাস করছে। মূলত কম ভাড়ায় কিংবা বিনা ভাড়ায় থাকতে পারার কারণেই দরিদ্র শ্রেণির লোকেরাই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। আবার কিছু গোষ্ঠী টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পদদেশে ঘর বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় বরাদ্দ দেয়।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড়-টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার ওপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিলার ওপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই এ রকম দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে।
বাংলাদেশ পরিবশে আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসাব মতে, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার ওপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।
জানা গেছে, নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এ ছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার।
সিলেটে পাহাড়-টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস ও প্রাণহানির জন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার। তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসে মৃত্যুর ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। দুর্ঘটনা ঘটলে মিডিয়ায় লেখালেখি হলে প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে। মৃতের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। এভাবেই কিছুদিন পর মৃত্যুর ঘটনা চাপা পড়ে যায়। অথচ আমরা চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে ভিডিও, ছবি এবং সচিত্র প্রতিবেদন দিয়েছি। কিন্তু তখন কেউ কোন উদ্যোগ নেয়নি। পাহাড়-টিলাসহ সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় প্রশাসনের গাফিলতির কারণে পাহাড়-টিলা ধসে মৃত্যু ক্রমশই বাড়ছে। শনিবারের টিলাধসে দুর্ঘটনার স্থান খাদিমনগর চা বাগান এলাকা আমরা সোমবার পরিদর্শন করে এসেছি। সেখানে এখনো ১০টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। যেকোন সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড়-টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই রায়ের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। কী পরিমাণ লোক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন তারও কোনো হিসেব নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তাদের পুনর্বাসন বা টিলা সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। বরং টিলা ধ্বংস করে অনেক প্রকল্প আছে। সরকারের এই নিস্ক্রিয়তার কারণেই বারবার এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, টিলার উপর ও পাদদেশে বসবাসকারীদের অনেক চেষ্টা করেও অন্যত্র সরানো যায় না। এ বছরও আমরা সব ইউএনওর মাধ্যমে মাইকিং করিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কীভাবে সরানো যায় ও পুনর্বাসন করা যায়, এ নিয়ে আমরা ভাবছি। তাদের মধ্যে যদি কেউ ভূমিহীন থেকে থাকেন, তাহলে প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হবে।