অবৈধ যানে দখল সড়ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ৫:৫৯:৪৫ অপরাহ্ন
বিআরটিএ’র দাবী, সিলেটে ফিটনেসবিহীন গাড়ি মাত্র ৮ হাজার
এমজেএইচ জামিল : দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয় গাড়ির ফিটনেস ছিল না। চালকের লাইসেন্স ছিল না। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে সড়ক পরিবহন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এতে দুর্ঘটনা যেন এখন নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে।
সিলেটসহ সারাদেশে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে সড়কে চলাচল করা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কত? সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের আসল সংখ্যা কত? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই সরকারি-বেসরকারি কোনও সংস্থা বা সংগঠনের কাছে। এই তিন ক্ষেত্রে একটি অপরটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও মিলছে না সঠিক তথ্য। কয়েকটি সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করলেও তথ্য বিভ্রাট লক্ষ্যনীয়। তবে সংশ্লিষ্টরা ধারনা করছেন সিলেটে বৈধ যানের দিগুণেরও বেশি হবে অবৈধ যান।
বিআরটিএ সিলেটের তথ্যমতে, সিলেট জেলায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৯৩টি। এরমধ্যে ৯৮টি অ্যাম্বুলেন্স, ১৮ হাজার ৮৮৯টি অটোরিক্সা, ৮৯৫টি অটো টেম্পু, ২১১টি বাস, ৮টি কার্গো ভ্যান, ৯২টি কভার্ড ভ্যান, ২৪৫টি ডেলিভারি ভ্যান, ১ হাজার ৯৩২টি হিউম্যান হলার, ২৯৭টি জিপ, ১ হাজার ৬৬৮টি মাইক্রোবাস, ১ হাজার ১০২টি মিনিবাস, ৬৯ হাজার ৩৭০টি মোটরসাইকেল, ২ হাজার ৪১৯টি পিকাপ, ১ হাজার ৪২৯টি কার, ৪৭টি বিশেষ যানবাহন, ১১৬টি ট্যাংকার, ২ হাজার ১৬৮টি ট্যাক্সি ক্যাব, ২২১টি ট্রাক্টর, ৩ হাজান ৬টি ট্রাক ও ৮৮২টি অন্যান্য যানবাহন রয়েছে।
এদিকে বিআরটিএ’র তথ্যমতে, সিলেট মহানগর এলাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬৯৭টি। এরমধ্যে ৩৩টি অ্যাম্বুলেন্স, ১টি অটোরিক্সা, ৩০টি বাস, ৭৪টি কভার্ড ভ্যান, ১৭টি ডেলিভারি ভ্যান, ১৪২টি হিউম্যান হলার, ৫৮টি জিপ, ৫০টি মাইক্রোবাস, ৫৪টি মিনিবাস, ৩৫ হাজার ৯৫টি মোটর সাইকেল, ২ হাজার ২২৫টি পিকাপ, ১৯৯টি কার, ৩৩টি বিশেষ যানবাহন, ৫টি ট্যাংকার, ২৮টি ট্যাক্সি ক্যাব, ১টি ট্রাক্টর, ১১৭টি ট্রাক ও ৫৩৫টি অন্যান্য যানবাহন রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরেও সড়কে চলাচল করা গাড়ির মধ্যে একটি বড় অংশই ফিটনেসবিহীন ও চলাচলের অনুপযোগী। অনিবন্ধিত এই যানবাহনের সংখ্যা কত, সেই তথ্য বিআরটিএ’র কাছে নেই। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির পরিমাণ কত সে তথ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। যদিও বিআরটিএ সিলেট অফিসের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন সিলেট জেলায় ফিটনেসবিহীন গাড়ীর সংখ্যা ৮ হাজার হতে পারে। অথচ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলায় শুধু অটোরিক্সাই আছে ৫০ হাজারের বেশী। অথচ বিআরটিএ’র তথ্যমতে সিলেটে নিবন্ধিত অটোরিক্সা ১৮ হাজার ৮৮৯টি। এতে বিআরটিএ’র তথ্যের সাথে বাস্তবের বিশাল ফারাক।
বিআরটিএ সংশ্লিষ্টরা জানান, যানবাহন মালিকদের এসএমএস-এর মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড ও ডাম্পিংসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছেন না বাস মালিকরা। এর ধারণা মেলে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক জরিপ প্রতিবেদনে। আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি জাতীয় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি সে সময় জানায়, ৮৩টি যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এর ফলাফলে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নেই অথবা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই ৩৩ শতাংশ বাসের, ৫৬ শতাংশের স্পিড গভর্ণর সিল নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসাব বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এরমধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি এবং অন্যান্য ১ হাজার ৪৬৬টি।
এ বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিআরটিএ অনেকবার জরিমানা ছাড়াই ফিটনেস সনদ হালনাগাদের সুযোগ দিলেও তেমন সাড়া দিচ্ছেন না মালিকরা। ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি সংশ্লিষ্টদের বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চালানোর চেষ্টা করেন তারা। এতে আনফিট বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনাও বাড়বে।
তার মতে, ফিটনেস পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করা না গেলে যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সেটি দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। এটির একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে আমলে নেওয়া উচিত। আইনের প্রয়োগটা যথাযথভাবে করতে হবে বিআরটিএকে। অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মৃত্যুর মিছিল থামাতে এর বিকল্প নেই।
বুয়েটের একটি সূত্র বলছে, ইঞ্জিনচালিত ভেহিক্যালের মধ্যে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রয়েছে আরও ১৫ লাখের মতো। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যাটা ৪০-৫০ লাখের কাছাকাছি এবং স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নসিমন-করিমনের মতো গাড়ির সংখ্যাও ১০ লাখের মতো হতে পারে। এসব যানবাহনের মধ্যে বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফিটনেস সনদ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, চাঁদাবাজি, অনৈতিক অর্থ লেনদেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে সড়কে আনফিট গাড়ি চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। পদে পদে পুলিশের হয়রানিও একটি বড় বাধা। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মহলকে ম্যানেজ করে চলেন মালিকরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিচালনা না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে প্রাণহানি ঘটছে।
বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে তারা সারা বছরই তৎপর থাকেন। নিয়মিত অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পরিবহন মালিকদের কারণেই মূলত ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে।
অভিযোগ আছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, রুট ভায়োলেশন/রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন, হাইড্রোলিক হর্নসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ে বিআরটিএ অভিযানে নামলেই বেঁকে বসেন যানবাহন মালিকরা। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলেই হঠাৎ সড়কে বাস নামানো কমিয়ে দেন তারা। সেই সঙ্গে বিআরটিএ’র অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কোনও পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। নতুন আইন অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি, বসে নেই।
বিআরটিএ সক্রিয় থাকার পরও সড়কে এত ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। তাদের লোকবলও আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে এসব গাড়ি সড়কে নামছে। আমরা তো অভিযান চালাচ্ছিই। আর কী করতে পারি?
সিলেট জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশ বলেন, সিলেট জেলায় ১২শ’র মতো বাস-মিনিবাস রয়েছে। যার সবগুলোই নিবন্ধিত। বাস নিয়মিত রাস্তায় চলাচল করে তাই ফিটনেস ঠিক রাখতে হয়। তবে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে ফিটনেস কম থাকতে পারে।
বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কোনও পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই বললেও বিআরটিএ সিলেটের সহকারী পরিচালক (এডি) ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন- সিলেট জেলায় ৮ হাজারের মতো ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে। এসব যানবাহনের তালিকাও তাদের হাতে আছে। এছাড়া প্রতি মাসে অন্তত ১৫ থেকে ১৬’শ যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন হালনাগাদের আবেদন জমা পড়ে।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এসএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাহফুজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে প্রতিদিনই অভিযান চালিয়ে থাকি। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়। এছাড়া সড়ক পরিবহন আইন ও ট্রাফিক আইন লংঘনজনিত কারণে মামলা দিয়ে থাকি। নগরীর বিভিন্ন স্পটে মামলা দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাফিক পুলিশ ফিটনেস না থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, ওভারলোড. ওভারস্পীড ও হেলমেট না থাকাসহ সড়কের যে কোন আইন লংঘনের কারণে মামলা দিয়ে থাকে। শুধুমাত্র ফিটনেসবিহীন কতটি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা হয় সেটি আলাদাভাবে হিসেব করা হয়না। তবে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
এদিকে, চলতি বছরের ৯ অক্টোবর বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬টি। যা ২০১০ সালে ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি। ফলে গত এক যুগে (২০১০-২০২২) নিবন্ধিত যানবাহন বেড়েছে ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে ৫-৬ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফিটনেস পরীক্ষা না করায় এবং নানান কায়দায় এসব গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে বর্তমানে ৫ লাখের বেশি যানবাহন মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসহীন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। তবে এসব যানবাহনের ৩০ শতাংশ সড়কে চলাচল করে না বলেও জানান তিনি। বিআরটিএ চেয়ারম্যান আরো বলেন, ফিটনেসহীন যানবাহনের ৩০ শতাংশ সড়কে চলাচল করে না। যেগুলো চলে, সেগুলোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি রাস্তা উন্নত হওয়ায় ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওভার স্পিডের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।