সবজির দামে নাকাল ক্রেতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৫:২৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির চাকায় পিষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। এরই মধ্যে লাগামছাড়া দামের কারণে কাঁচাবাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। নিম্নআয়ের মানুষ যখন বাজারে গিয়ে মাছ মাংস কিনতে না পেরে সবজির দিকে ঝুকছেন তখন তা যেন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।শুক্রবার নগরীর কাঁচাবাজার গুলোতে ঘুরে দেখা যায় যে, বিভিন্ন শাক-সবজি, মাছ, মাংসসহ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। ক্রেতারা দোষ দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
ক্রেতাকার জানান, বাজারে সবজির দাম অনেক বেশি। ফলে অস্বস্তিতে পড়ছেন বাজার করতে আসা মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। বিক্রেতারা বলছেন, এখনো পর্যাপ্ত শীতকালীন সবজি না আসার কারণে দামও তুলনামূলক কিছুটা বেশি। তবে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এই দাম কমে আসবে বলে জানান বিক্রেতারা।শুক্রবার নগরীর বন্দরবাজার এলাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সবজি তুলনামূলক কম। তাই সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই থাকছে শীতের সবজি। সাধারণত এই মৌসুমে শীতকালীন সবজি লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, দেশি পিঁয়াজ, ভারতীয় পিঁয়াজ, বেগুন, মুলা, লালশাক, পালংশাক, পটোল, ঢেঁড়স, বরবটি, ঝিঙা, পেঁপে, আলু, করলা, কচু, শসাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজিতে ভরপুর থাকে বাজার।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সিম প্রতি কেজি ২০০ টাকা দরে, টমেটো ১২০ টাকা কেজি দরে, ঢেঁড়স ৮০ টাকা কেজি দরে, করলা ৮০ টাকা কেজি দরে, বেগুন ৭০ টাকা কেজি দরে, মুলা ৬০ টাকা কেজি দরে, পটল ৮০ টাকা কেজি দরে, মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা কেজি দরে, পেঁপে ৩০ টাকা কেজি দরে, কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া শসা ৮০ টাকা, গাজর ১২০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, আলু ৫৫ টাকা কেজি, ফুলকপি (ছোট) ১৮০-২০০ টাকা কেজি বাঁধাকপি (ছোট) ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে, ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা কেজি। সোনালি মুরগির দাম রাখা হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা। গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি। রুই মাছের কেজি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আর পাঙাশ ও তেলাপিয়ার দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্য উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল রয়েছে।
বাজার করতে আসা রহিমান বেগম নামের এক গৃহবধু বলেন, জিনিসপত্রের যা দাম তাতে মাছ মাংসের দোকানে ভুলেও যাওয়া হয় না। কিন্তু সবজির দামও এখন আকাশছোঁয়া। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে আসলে অর্ধেক ব্যাগ ভরে না।আরেক ক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহ থেকে এ সপ্তাহেই জিনিসের দাম ১০/১৫ টাকা বেড়েছে। এভাবে সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়লে আমাদের মতন মধ্যবিত্তরা কিভাবে চলবে বলেন? সবজি বিক্রেতা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সামনে মাস থেকে সবজির দাম আশা করি কমতে শুরু করবে। এ বছর বৃষ্টির কারণে শীতাকালীন সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। বাজারে এখন যে চাহিদা রয়েছে সে চাহিদা অনুযায়ী যোগান নেই। ফলে দামও কিছুট বাড়তি।
এদিকে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে বাজারে কাটছাট করছেন অনেকেই। এই তালিকায় মধ্যবিত্ত থেকে শ্রমজীবি সকল শ্রেণীর মানুষ রয়েছে।রফিক আহমদ নামের এক ক্রেতা জানান, ইট-পাথরের এ শহরে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতেই আয়ের বেশিরভাগ অংশ চলে যায়। এরমধ্যে ঘর ভাড়া তো আছেই। ফলে কোনোমতো খেয়ে-পরে বাঁচতে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসারের খরচ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন তিনি।তিনি বলেন, প্রতি মাসে খরচ হতো ১২ হাজার টাকা। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাজারে দর চড়া, হিমশিম খাচ্ছি। আগে প্রতিদিন গড়ে হাতে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা থাকত। এখন সেটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্টো কয়েক মাস থেকে ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছি। সংসারের মাসিক বাজার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি।
রফিকের মতো কয়েকজন সাধারণ ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতিদিন সকালে রুটি বানাতে কারো প্রায় এক কেজি আটা লাগতো। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে বাদ যায়নি আটাও। তাই আধা কেজি আটায় তৈরি রুটিতেই সকালের নাস্তা সারেন তারা। মাছ-মাংস আগে মাঝে-মধ্যে জুটলেও এখন একদমই কিনতে পারছেন না।ছেলে-মেয়েদের মুখে মাঝেমধ্যেও ভালো খাবার তুলে দিতে না পারায় দুঃখপ্রকাশ করে একাধিক ক্রেতা বলেন, ‘গত কোরবানির সময় স্থানীয় লোকজন বাসায় গোস্ত দিছিল, সেইটা দুই দিন খাইছি। এরপর থেকে আর গরুর গোস্ত কিনতে পারিনি।’
শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সকালে নগরীর মদীনামার্কেট এলাকায় নিম্ন আয়ের ভ্যানচালক হাফিজুর বলেন- ‘বাবারে এই দ্যাশটা এখন বড় লোকের। আমাগো মতো গরিবরা দামের কারণে কিচ্চু খাইবার পারতাছে না। কি খামু, সবকিছুরই তো আগুন দাম।’শুধু ভ্যানচালক হাফিজুরই নয়, তার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এ নগরীর খেটে খাওয়া হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষেরও একই দশা। নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় খাবার কিনে খাওয়াই যেন তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। অনেকের আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আবার চাল আনতেই কারও কারও ডাল-সবজি কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা আকাশ। প্রায় ২ বছর ধরে সুবিদবাজার এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতি মাসের ১৫ দিন না যেতেই আগে গ্রামে ছুটে যেতেন। পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন থেকে পরে ফের চলে আসতেন ঢাকায়। বছরে তার অন্তত ১২ বার বাড়ি যাওয়া যেন নির্দিষ্ট রুটিন ছিল। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী এই বাজারে মাসে একবার তো দূরের কথা, এখন বাড়ি যাবেন তা-ও ভাবতে পারেন না।
তিনি বলেন, আগে কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জের বাস ভাড়া ছিল ১শ টাকা। এখন বেড়ে ১৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আবার সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে আগে ৩০-৪০ টাকা লাগতো। এখন সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে লাগে ২০০ টাকা। তাই এখন বাড়ি যাব ভাবতেই পারি না। আবার দুই ছেলে-মেয়েকে প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া করানো, সংসারের খরচ- এসব জোগাতেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আকাশ বলেন, ‘আগে প্রতি মাসে বাড়িতে ১২ হাজার করে টাকা পাঠাতাম। এখন ১৫ হাজার পাঠাই। কিন্তু এরপরও বউ কয় এ টাকাতেও হচ্ছে না। আমাকেও তো চলতে হবে সিলেটে। বাধ্য হয়ে এখন দুপুর থেকে গভীর রাত অবধি রিকশা চালাই। আগে চালাতাম মাত্র এক বেলা। আর গ্রামে যাই প্রতি চার-তিন মাস পরপর। ছেলেটাকে টাকার জন্য প্রাইভেট মাস্টার দিতে পারছি না।’
নগরীর রিকাবীবাজার, কাজিরবাজারম শামিমাবাদ ও শেখঘাট এলাকার বেশ কয়েকজন রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা হলে তারাও সংসার চালাতে এমন হিমশিমের কথা জানিয়েছেন। আবার রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে খেয়ে-পরে ঢাকায় থাকতেও অসুবিধার কথা জানিয়েছেন অনেকে। তারা আরো বলেন তাদের খাবারের দাম বেড়েছে। আগে বাইরে ডিম-ভাত ৩০-৪০ টাকায় খেতে পারলেও এখন সেটা ৫০-৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যে রুটি ১০ টাকায় খেতেন তা বেড়ে ১৫ হয়েছে। তবে পণ্যের দাম বাড়লেও আয় বাড়েনি নিম্মআয়ের এসব মানুষদের।
রিকশাচালক আকিবুরের দাবি, ‘সবকিছুর দাম বাড়ায় এখন মানুষজন রিকশায় বেশি চড়ে না। আর চড়লেও স্বল্প দূরত্বের ভাড়াই বেশি। অনেকেই রিকশায় অর্ধেক রাস্তা গিয়ে নেমে যান, বাস ধরবেন এ অজুহাতে। পরে হেঁটেই বাকি পথ যান কেউ কেউ।’
অপর রিকশাচালক কবিরুল বলেন, ‘আয় অর্ধেকে নেমেছে। আগে এক দিনে হাজার টাকা আয় করতে পারতাম। কিন্তু রিকশার সংখ্যা বাড়ায় সেই আয় করতে এখন লাগে দুই দিন।’নগরীর রিকশাচালক কিংবা শ্রমজীবী মানুষেরা বলছেন, তারা কেউ ভালো নেই। নিত্যপণ্যের দামের কারণে মাছ-মাংস আর কিনতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ডিমে সেই ঘাটতি পূরণ করছেন কেউ কেউ। তবে বেশিরভাগই জানিয়েছেন দ্রব্যমূল্যের বাজারে খেয়ে-পরে বাঁচতে মাসিক বাজার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন। নিত্যপণ্যের সাথে সবজি বাজারের লাগামছাড়া দামে খেটে খাওয়ার মানুষের বেচে থাকায় দায় হয়ে পড়েছে।