নগরে বাড়ছে ‘সাবলেট ভাড়া’ চাহিদা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৫৮:০৮ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : পাগলা ঘোড়ার পিঠে চেপে ক্রমেই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। পাশাপাশি বেড়েছে সংসারের খরচও, ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়ও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীরবে বাড়ছে এই বাসা ভাড়া। সব মিলিয়ে চরম হিমশিমে নগরীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে কেউ ঝুঁকছেন সাবলেটে, কেউ যাচ্ছেন এক রুমের আধাপাকা বা টিনশেডের বাড়িতে। আবার কেউ যাচ্ছেন শহর ছেড়ে গ্রামে কিংবা ঢাকার আশপাশের নিম্ন ভাড়ার বাড়িগুলোতে।
রোববার থেকে নগরীর লামাবাজার, রিকাবীবাজার, মদীনা মার্কেট ও কানিশাইলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শোভা পাচ্ছে ‘সাবলেট ভাড়া’র আবেদনের পোষ্টার। সাথে জুড়ে দেয়া আছে শর্ত। ছোট পরিবার ও চাকুরীজীবি অগ্রাধিকার।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে ব্যয়, বাড়েনি মানুষের আয়। কঠিন এই পরিস্থিতিতে এ সময়ে বাসা ভাড়া বাড়াচ্ছেন বাড়িওয়ালারা, যা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এই ভাড়া বৃদ্ধি যেন ভাড়াটিয়াদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আগে বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানো হলেও এখন নির্ধারিত কোন সময় নেই। মালিকের ইচ্ছামতো যে কোন সময় বাড়ছে বাসা ভাড়া।
আব্দুর রহমান ও রাফিয়া বেগমের সংসার জীবন সাড়ে চার বছরের। এরমধ্যে ঘর আলো করে এসেছে ছেলে লাবিব। গত দেড় বছর থাকছেন নগরীর পাটানঠুলায় দুই রুমের ভাড়া বাসায়। এবার তারা নতুন ‘সাবলেট’ বাসা খুঁজছেন। প্রাইভেট চাকুরীজীবি আব্দুর রহমান বলেন, ‘আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না, তাই বাসাটা ছেড়ে দিয়েছি। একটা সাবলেট খুঁজছি। পকেটের অবস্থা, বাজারের ঊর্ধ্বগতি, সেই সাথে সংসারের খরচ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বউ ছোটখাটো একটা চাকরি করত, বাবু আসার পরে ছাড়তে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মাসে বেতন পাই ২০ হাজার টাকা। দুই রুমের বাসা ভাড়া ছিল ১০ হাজার। সাথে বিদ্যুৎবিল, পানির আলাদা বিল ও ময়লা বিল মিলে আরো ১ হাজার টাকা গুণতে হয়। এরমধ্যে গতমাসে বাড়িওয়ালা আরো ১ হাজার টাকা বাসা ভাড়া বাড়িয়েছে। অন্যদিকে গত দুই বছরেও বেতন বাড়েনি। প্রথমে চিন্তা করেছিলাম স্ত্রী-সন্তান গ্রামে পাঠিয়ে দেব। হিসাব করে দেখলাম, তখন খরচ আর ভোগান্তি দুটোই বাড়বে।’
নগরীর অন্তত ৭/৮ টি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাসশেষে টু-লেট বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বেড়েছে সাবলেট প্রত্যাশীদের আবেদন। কেউ বাসা ছেড়ে সাবলেট ভাড়া দিচ্ছেন, কেউবা নিজেকে গুটিয়ে বাসার একটি রুম সাবলেট হিসেবে দিচ্ছেন।
নগরীর শামীমাবাদ এলাকায় তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে থাকেন রশিদ আহমদ। তার সাথে সাবলেট ভাড়া হবে- এমন বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের নিয়ে কথা হয়। সাবলেট প্রত্যাশী একজনের সাথে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে থেকে রান্নাঘর কোথাও তিল ধরার জায়গা নেই। সাবলেট হিসেবে নির্ধারণ করা রুমটিতে রয়েছে এটাচ বাথরুম, বারান্দা। অন্য দুই রুমের জন্য পাকঘর লাগোয়া টয়লেট। ঘরে তার বৃদ্ধ বাবা-মাসহ পাঁচজন থাকেন।
ভাড়া নিয়ে আলাপকালের একপর্যায়ে রশিদ বলেন, ‘এটাচ বাথরুম ছাড়া বেশি টাকায় সাবলেট ভাড়া দেওয়া যায় না। অন্যদিকে পরিবারে খরচ বেড়েছে। বিদ্যুৎ থেকে পানি বিল সবই বেড়েছে। সবগুলো রুমই প্রয়োজন পরিবারের, তাও নিজেদের গুটিয়ে সাবলেট ভাড়া দিতে হচ্ছে।’
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান মূল্যস্ফীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর। তার চেয়েও বেশি চাপে দিন পার করছে মধ্য আয়ের মানুষ। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজারের লাগাম টানা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন।
বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের সংসার। মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে কখনো সঞ্চয় ভেঙে কখনো আবার ধারদেনা করেই চালাতে হয় সংসার। শখ করে একটা কিছু কেনা, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। মেহমান এলে যতটা খুশি হন তার চেয়ে যথার্থ আপ্যায়ন করতে না পেরে খারাপ লাগে।
সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা লোকমান আহমদ একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আলাপকালে তিনি বলেন, বেতন পাই মাসে ২০ হাজার টাকা। অফিস জিন্দাবাজারে হলেও কম টাকায় বাসা পাওয়া যাবে বলে এখানে থাকা। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানো বড়ই কঠিন হয়ে গেছে। বেতন পাওয়ার প্রথম ১০ দিনে মধ্যে হাত খালি হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো চলতে হয় কষ্ট করে। গ্রামে বাবা-মাকে নিয়মিত টাকা পাঠানোরও অবস্থা থাকে না। বাসা ভাড়াতেই সব শেষ। তার মধ্যে আছে বছর শেষে ভাড়া বাড়ার চিন্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপ্রিল-জুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি ভাড়া ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জীবনযাত্রাকে আরও ব্যয়বহুল করেছে। হাউজ রেন্ট ইনডেক্স (এইচআরআই) অনুযায়ী, ভাড়ার খরচ (ত্রৈমাসিক থেকে ত্রৈমাসিক) শূন্য দশমিক ১২ শতাংশীয় শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে, যা আগের অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে ছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এছাড়া, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে বাড়ি ভাড়ার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাড়ি ভাড়ার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। কংক্রিট, ঢেউটিন লোহার শিট ও মাটির ঘর- এই তিন ক্যাটাগরির বাড়ি ভাড়ার খরচ সংকলন করে বিবিএস তাদের হালনাগাদ এইচআরআই প্রকাশ করেছে।
এইচআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল-জুন ত্রেমাসিকে সর্বোচ্চ ভাড়া বেড়েছে মাটির ঘর ক্যাটাগরিতে, এর সম্পর্কিত সূচক ১১০ দশমিক ৮৩ থেকে বেড়ে ১১১ দশমিক ১৯ হয়েছে।
বিবিএসের এক কর্মকর্তার মতে, বাড়ি ভাড়া ভোক্তা মূল্য সূচকের নন-ফুড ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। দেশের ভাড়াটেদের সংগঠন বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি সুলতান বাহার বলেন, বাড়ির মালিকরা যখন-তখন ভাড়া বাড়ালেও বিষয়টি দেখার কেউ নেই। তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট-১৯৯১ থাকলেও, এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বর্তমানে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আয়ও বেড়েছে। কিন্তু যে হিসেবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সে হিসেবে মানুষের আয় বাড়েনি। এর জন্য মানুষের অনেক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আছেন তাদের চলা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় বাড়লেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।