প্রাথমিকের সাড়ে ১১ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্যে অসংগতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:২০:৩১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছরই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কমছে। এমনকি করোনায় একটানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও। এতে করে আশার সঞ্চার হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ঝরে পড়ার হারে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কারণ অনেক তথ্যেই গরমিল রয়েছে। যেখানে চর-হাওর, দুর্গম অঞ্চল, নদীভাঙন এলাকা ও বস্তিবাসী শিশুর সঠিক তথ্য নেই, সেখানে ঝরে পড়ার হার কমার তথ্য অনেকটাই অস্বাভাবিক।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৩ দশমিক ৯৫, ২০২১ সালে ১৪ দশমিক ১৫, ২০২০ সালে ১৭ দশমিক ২০, ২০১৯ সালে ১৭ দশমিক ৯০, ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর মাধ্যমিকে ২০২২ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ।প্রাথমিকে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বেশি। তবে মাধ্যমিকে গিয়ে ভিন্ন চিত্র। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২১ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ২ কোটি ১ লাখ ৯৭২ জন। শুধু প্রাথমিকে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৭ জন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ২৫১, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৯, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫২, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩১ লাখ ৫৪ হাজার ৯১৮ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩৬ লাখ ৪ হাজার ৪২৭ জন।
২০২২ সালে দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৩। এতে শিক্ষার্থী ছিল ১ কোটি ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৪৩ জন। আর দাখিল পর্যায়ের মাদ্রাসা ৬ হাজার ৫২১টি, এতে শিক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ১২ হাজার ৫৬২ জন। কারিগরিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধু নবম ও দশম শ্রেণি রয়েছে।
২০২২ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২১ লাখ ৬২ হাজার ৬২৩, সপ্তম শ্রেণিতে ২০ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৬, অষ্টম শ্রেণিতে ২১ লাখ ২০ হাজার ৪৪৬, নবম শ্রেণিতে ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৮ ও দশম শ্রেণিতে ১৮ লাখ ৬ হাজার ৬৬০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২১ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ছিল ৩৬ লাখ ৪ হাজার ৪২৭ জন। যাদের ২০২২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু ওই বছর স্কুলপর্যায়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ২১ লাখ ৬২ হাজার ৬২৩ জন; অর্থাৎ ভর্তির বাইরে ছিল ১৪ লাখ ৪১ হাজার ৮০৪ জন। যদিও এদের মধ্যে একটা অংশ দাখিল স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়, যাদের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখের মতো। এরপরও পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির উপযোগী ১১ লাখ ৪১ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থী কোথায় গেল, এর কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই ছাপার তথ্যেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রমাণ মেলে। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর বই ছাপা হচ্ছে। অথচ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ছাপা হয়েছিল ৪ কোটি ১৫ লাখ ৩৮১ শিক্ষার্থীর বই। সেই হিসাবে প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে। যার বেশিরভাগই ঝরে পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মাছুম বিল্লাহ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ব্যানবেইস থেকে ঝরে পড়ার হারের যে তথ্য পাই তা শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়। একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। ২০১৯ সালে ব্র্যাকের স্কুল ছিল ২৫ হাজার, কিন্তু তারা উল্লেখ করেছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি।’ তিনি মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের পরিকল্পনার বড় অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এতে পড়ালেখার মানও বাড়বে, ঝরে পড়াও কমবে।
জানা যায়, ঝরে পড়ার মূল কারণ দারিদ্র্য। তবে পারিবারিক চাপে অনেক সময় চরাঞ্চল, হাওরাঞ্চল, নদীভাঙন, দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের পড়ালেখার বদলে কাজে লাগিয়ে দেয়। দারিদ্র্য আর অসচতেনতার কারণে বাল্যবিয়েরও শিকার হয় মেয়েরা।
২০২১ সালে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছিল, করোনাকালে দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ওই বছরই এডুকেশন ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, করোনা-পরবর্তী বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। মাধ্যমিকের ৪১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে এবং ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঝরে পড়ার হার প্রতিবছরই কমছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচাক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকলেও ডিজিটাল মাধ্যমে লেখাপড়া হয়েছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছেন। ফলে স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের মনে ভয় ছিল না। আর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূল ধারায় নিয়ে এসেছি। এ ছাড়া উপবৃত্তি বড় ভূমিকা পালন করছে। এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে প্রতি বছরই আমাদের ঝরে পড়ার হার কমছে।’
২০২১ সালে প্রকাশিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে। ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সে। আর ১ দশমিক ৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দারিদ্র্য এবং কঠিন জীবন ধারণের কারণে তারা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়েতে বিশে^ শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। দেশে বাল্যবিয়েতে শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। জেলার মধ্যে শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২১ কোটি ২০ লাখ। বাংলাদেশে আছে ৩২ লাখ। এর মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ কাজ করে কৃষি খাতে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ শুমারির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। ২০২১ সালে কমে হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। আর ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি; অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৮ হাজার ৪৬৩টি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, শিশুশ্রম বেড়েছে, বাল্যবিয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে কমেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা। দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারটি গুরুত্বের প্রথম তালিকায় রাখেনি। আয় বাড়ানোর তাগিদে তারা ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে ঝরে পড়ার হার কমার তথ্য অনেকটাই অস্বাভাবিক।