প্রয়াণের ৯ বছর: অধ্যাপক গোলাম আযম একটি ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ৭:৩৭:৫৭ অপরাহ্ন
অধ্যাপক গোলাম আযম একটি ইতিহাস : মোহাম্মদ অলিদ বিন সিদ্দিকী তালুকদার
দেখতে দেখতে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে কিভাবে চলে গেলো ৯টি বছর। মনে হয় এই তো সেদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শরীক হয়েছিলাম তার নামাজে জানাজায়। সেটি ছিল আমার জীবনে দেখা ও শরীক হওয়া সব চেয়ে বড় জানাজা। যে জানাজায় ইমামতি করেছিলেন তার চতুর্থ পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বর্তমানে নিখোঁজ) আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী। মগবাজারের কাজী অফিস লেনস্থ নিজ বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত এ কিংবদন্তিকে শিক্ষক, লেখক, চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কী সম্বোধনে স্মরণ করবো?
অধ্যাপক গোলাম আযম আজকের রাজনীতির এ সংকটকালে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তার প্রণীত কেয়ারটেকার ফর্মুলাই একদিন জাতিকে মুক্তি দিয়েছিল সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসকের কবল থেকে। তিনি জীবদ্দশাতেই ছিলেন কিংবদন্তী। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ডাকসুর সাবেক এই জিএসের মৃত্যুবার্ষিকী ২৩ অক্টোবর। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফর্মুলা’ উপস্থাপন করেন। কতো অগ্রসর চিন্তায় এমন একটি ফর্মুলা আবিস্কার করেছিলেন তিনি। আজকের প্রেক্ষাপটেও তা ভাবনার বিষয়। ৯২ বছর বয়সে ২০১৪ সালের এই তারিখে রাত ১০টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে ইন্তেকাল করেন তিনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে। কারো প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি কোন পর্যায়ে গেলে জানাজায় জনতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ঘটে নিজ চোখেই তা দেখা হয় সেদিন। অধ্যাপক গোলাম আযমের নামাযে জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকেই ঢাকায় জনতার ঢল নামে। ওই জনস্রোতের গন্তব্য বায়তুল মোকাররমমুখী। সকাল ১১ নাগাদ কানায় কানায় ভরে যায় বায়তুল মোকাররম উত্তর এবং দক্ষিণ গেটসহ তার চারপাশ, পল্টন ময়দান, গুলিস্তান, জিপিও, দৈনিক বাংলার মোড় হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত। জানাযাকে ঘিরে বায়তুল মোকাররম ও আশপাশের এলাকায় গড়ে তোলা হয় নিরাপত্তা বলয়। সরকার সমর্থক কয়েকটি সংগঠন জানাযা ঠেকানোর ঘোষণা দিলেও পরিস্থিতি বুঝে ধারে-কাছেও ঘেঁষেনি তারা।
গোলাম আযমের জন্ম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর (বাংলা ১৩২৯ সালের ৫ই অগ্রহায়ন) সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের শাহ সাহেব বাড়িতে। তার নানা শাহ সৈয়দ আবদুল মোনায়েম পরিচিত ছিলেন শাহ সাহেব নামে। গোলাম কবির ও সৈয়দা আশরাফুন্নিসার সন্তান গোলাম আযমের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগরের বিরগাঁও গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন ঢাকার বড় মগবাজারের কাজী অফিস লেনের বাড়িতেই। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা গোলাম আযম বিরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় লেখাপড়া শুরু করলেও একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৩৭ সালে জুনিয়র মাদরাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ছিলেন ত্রয়োদশ স্থানে। ১৯৪৪ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকেই আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ঢাকা বোর্ডে দশম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় গোলাম আযম পরীক্ষা দিতে পারেননি এবং ১৯৪৯ সালে দাঙ্গাজনিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি ১৯৫০ সালে এমএ পরীক্ষা দেন। ঐ বছর কেউ প্রথম বিভাগ পাননি। চারজন ছাত্র উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগ লাভ করেন। গোলাম আযম তাদের একজন।
১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। রংপুর কারমাইকেল কলেজে ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। নিজ বিভাগের ছাত্ররা ছাড়াও অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররাও তার লেকচার শুনতে জড় হতো।
ছাত্রজীবন শেষে অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫০ সালেই তাবলিগ জামাতের তৎপরতার সাথে জড়িত হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তাবলিগ জামাতের রংপুরের আমীর ছিলেন। তাবলিগ জামাত যেহেতু ধর্মীয় প্রচার ও মিশনারি দায়িত্ব পালন করছিল, তাই তিনি শুধু তাবলিগ জামাতের কাজ করেই তৃপ্তি পাননি। সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি তাবলিগ জামাতের ছিল না। তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে বক্তব্য থাকায় গোলাম আযম তমদ্দুন মজলিসের কাজেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েন ১৯৫২ সালেই। ১৯৫৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি তমদ্দুন মজলিসের রংপুর জেলার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪ সালের এপ্রিলে জামায়াতে ইসলামীতে সহযোগী (মুত্তাফিক) হিসেবে যোগদান করার পর ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়ে রংপুর কারাগারে অবস্থানকালেই জামায়াতের রুকন হন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর এক বছর পর তাকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭১ সেশনে তিনি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব-পাকিস্তানের আমীর নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে মজলিসে শূরার কাছে বিশেষ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমীরে জামায়াতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতের অন্যতম নেতা হিসেবে এবং বিশেষভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে উত্তপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম বিরোধীদলীয় আন্দোলনে একজন প্রথম সারির ভূমিকা পালন করেছেন। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনেও গোলাম আযম অংশ গ্রহণ ছিল একটি ঘটনা।
১৯৬৪ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য চার দিনব্যাপী বৈঠকে ৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরোধীদল গঠন করা হয়। সম্মিলিত বিরোধীদলের তৎপরতা পরিচালনায় অধ্যাপক গোলাম আযম বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল শাসরুদ্ধকর স্বৈরশাসনের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য আতাউর রহমান খানের বাসভবনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সর্বজনাব নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী ও আতাউর রহমান খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, তোফাজ্জল আলী ও সৈয়দ খাজা খায়েরুদ্দিন, জামায়াতে ইসলামীর মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ, মাওলানা আব্দুর রহীম ও অধ্যাপক গোলাম আযম, আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আব্দুস সালাম খান ও গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর এবং নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও এমআর খানকে নিয়ে ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট’ গঠিত হয়। পিডিএম আট দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আব্দুস সালাম খানকে সভাপতি এবং অধ্যাপক গোলাম আযমকে জেনারেল সেক্রেটারি করে পূর্বাঞ্চলীয় পিডিএম কমিটি গঠিত হয়। পিডিএমের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম দিনরাত পরিশ্রম করেন এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৬৯ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন জানুয়ারি মাসে নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করায় দেশব্যাপী এক প্রচ- গণজাগরণের সূচনা হয়। সমগ্র দেশব্যাপী সুষ্ঠুভাবে গণআন্দোলন পরিচালনার তাগিদে ৭ ও ৮ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী বৈঠকে (১) ন্যাপ, (২) আওয়ামী লীগ (৬ দফা), (৩) নেজামে ইসলাম পার্টি, (৪) জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, (৫) কাউন্সিল মুসলিম লীগ, (৬) জামায়াতে ইসলামী, (৭) এনডিএফ, (৮) আওয়ামী লীগ (৮ দফা পন্থী)- এ আটটি দলের নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি-ডাক গঠন করা হয়। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানকে ডাক-এর আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ সম্পাদক হয়ে মুল নেতৃত্বে চলে যান। তিনি প্রথম, জামায়াতের আমির হন ৬৯ সালে। এরপর তিনি আর প্রকাশ্য জনসভায় আনেনি। প্রায় এক দশক পর ৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর যখন গোলাম আযমকে জামায়াতের প্রকাশ্য আমির ঘোষণা করা হলে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন হয়। সেই আন্দোলনের লক্ষবস্তু ছিলেন তিনি।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট (সাপ্তাহিক)।