সিলেটের হাসপাতালে শিশু রোগীর চাপ : মিলছেনা শয্যা !
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ৪:৫৬:৩৪ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : দেশজুড়ে তাপমাত্রা কমতে থাকলেও, এখনো নামেনি শীত। এরই মধ্যে সিলেটের ঘরে ঘরে টাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। নগরীর সরকারি বেসরকারী হাসপাতালে শিশু রোগীর চাপ বাড়ছে। অনেক হাসপাতালে গিয়েও খালি মিলছেনা শিশুরোগীর শয্যা। রোগীর চাপে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাধ্য হয়ে এক বেডে ৫ জন শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করে সিলেটের হাসপাতালগুলোতে শিশু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিশুরা হাজির হচ্ছে হাসপাতালে। আক্রান্তদের মধ্যে জলবসন্ত, ফুসকুড়ি, ডায়রিয়া, সর্দি জ্বর, টাইফয়েডের রোগী থাকলেও, অধিকাংশ শিশু নিউমোনিয়া ও টাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত বলে বিভিন্ন হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঠান্ডাজনিত রোগে নবজাতক থেকে শুরু করে ৭-৮ বছরের অনেক শিশু নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। বিকেলের দিকে অনেক অভিভাবক হাসপাতালে বেড না পেয়ে আউটডোর কিংবা জরুরী বিভাগে চিকিৎসক দেখিয়ে সন্তান নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ভর্তি হওয়া এবং ফিরে যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগই সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।
শনিবার বিকেলে ১০ মাস বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে নগরীর রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের গৃহবধু নাসরিন আক্তার (২৮)। সেখানে সন্তানের জন্য কোন সীট খালি না পেয়ে চলে যান উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও কোন সীট খালি পাননি। তাৎক্ষণিকভাবে জরুরী বিভাগে চিকিৎসক দেখিয়ে সীটের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। বিকেল ৩টার পর একটি সীট খালি হলে সন্তানকে ভর্তি করাতে সক্ষম হন তিনি। তার সন্তান গত এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডাজনিত রোগে ভূগছিল। স্থানীয় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রেও কোন উন্নতি হয়নি। এক পর্যায়ে বাচ্চার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকের মধ্যে কফ জমে আওয়াজ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ২ হাসপাতাল ঘুরে সন্তানের জন্য একটি সীট পেতে সক্ষম হন তিনি। তখন একাধিক শিশুর অভিভাবক সীট খালি না পেয়ে অন্য হাসপাতালে ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছে নাসরিন আক্তার।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪ শতাধিক শিশু চিকিৎসাধিন আছে। একটি সীটে ৫জন শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূইয়া। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত কয়েকদিন থেকে হাসপাতালে শিশুরোগীর চাপ বাড়ছে। শিশুদের ফ্লোরে দেয়া যায়না। আবার কাউকে ফিরিয়েও দেয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে হাসপাতালের একটি বেডে ৫জন শিশুকে রেখেও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত ওসমানী হাসপাতালের ৩টি সাধারণ শিশু ওয়ার্ডে ১০৬ শয্যার বিপরীতে ২৯৯ জন শিশু রোগী ভর্তি রয়েছে। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. তারেক আজাদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত সপ্তাহ থেকে শিশু রোগীর চাপ বাড়ছে। হাসপাতালটিতে শিশুদের জন্য আলাদা ১২০টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু সকল শয্যা পূরণ থাকায় নতুন রোগি ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। সকালের দিকে পুরাতন রোগীকে ছাড়পত্র দিলেই শয্যা খালি পাওয়া যাচ্ছে।
সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. হিমাংশু শেখর দাস দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, হঠাৎ করেই গত কয়েকদিন থেকে হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বেশীর ভাগ শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত। পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় বিপুল সংখ্যক শিশু রোগীকে ভর্তি করা যাচ্ছেনা। ফলে বাধ্য হয়ে সীট না পেয়ে অনেক অভিভাবককে ফিরে যেতে হচ্ছে। উইমেন্স হাসপাতালে শিশুদের জন্য ১০০ আলাদা শয্যা রয়েছে। শিশুদের নিয়ে কেবিনে ভর্তির প্রবণতা কম।
সিলেটের ডেপুটী সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় শংকর দত্ত দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটজুড়ে শিশুদের টাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপ হঠাৎ করে বেড়েছে। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। এজন্য অভিভাবকদেরকে শিশুদের প্রতি অধিক যত্নবান হতে হবে।
তিনি জানান, জেলার আওতাধিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রতিদিন শিশুকে নিয়ে ভিড় করছেন রোগীর স্বজনরা। তবে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শেষ করে খুব কম শিশুই বাড়ি ফিরতে পারছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এদিকে জরুরি অনেক রোগীকে চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা বললেও বেড খালি না পেয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেছে। আর হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে সিলেটের বাইরে থেকে আসা রোগীদের। বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বেশী থাকায় অনেকেই তার শিশুকে ভর্তি করতে পারছেন না।
পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ সালাম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালে ২৫ জন শিশু রোগী ভর্তি রয়েছে।
শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক সার্জন (আরএমও) ডা. মিজানুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৫জন শিশু রোগি ভর্তি রয়েছে। তবে বর্হিবিভাগে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক শিশু বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।
সিলেটে হঠাৎ শিশুরোগী বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এখনো শীত না নামলেও হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে নবজাতক ও শিশুরা নানা ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে শিশুদের অধিকাংশই কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ভাইরাসজনিত কারণে ডায়রিয়াও দেখা দিচ্ছে। এজন্য এই সময় শিশুদের বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তাতে শিশুদের নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।তিনি বলেন, শীতের নামার প্রাক্কালে নবজাতক ও শিশুদের কোনোভাবে ঘরের মেঝেতে বা সেঁতসেঁতে জায়গায় রাখা যাবে না। এ সময় সব শিশুদের কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে। সুষম খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। বাড়তি সচেতনতা ছাড়া শিশুদের টাণ্ডাজনিত রোগ থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।