আরিফের বিদায়, আনোয়ারের অভিষেক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ৮:৪৩:৩৩ অপরাহ্ন
# আনোয়ারুজ্জামান চাইলেন সহযোগিতা, কৌশলী হওয়ার পরামর্শ আরিফের

মুনশী ইকবাল :
৭ নভেম্বর মঙ্গলবার, বেলা ৩টা বেজে ১০ মিনিট। সিলেট সিটি কর্পোরেশন চত্ত্বরে সাজ সাজ রব। বর্ণিল সামিয়ানার নিচে সারি সারি চেয়ারে অতিথিরা। সামনে লাল নীল বাতিতে বিশাল মঞ্চ ঝলমল করছে। এমন সময় বিশাল বহর নিয়ে সিসিকের গেট দিয়ে প্রবেশ করলেন নব নির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে নিয়ে তিনি যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুইদিক থেকে অতিথি ও উপস্থিত সকলের মুহুর্মুহু করতালি। এর ১০ মিনিট পর দশ বছরের স্মৃতি-বিস্তৃতি ও কর্মবহুল সিসিকের গেট দিয়ে প্রবেশ বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। স্ত্রী-কে নিয়ে যখন ঢুকলেন ভেতরে মুহূর্তেই বদলে গেল পরিবেশ। সবাই দাঁড়িয়ে জানালেন হৃদয়নিংড়ানো অভিবাদন। একের পর এক করলেন করমর্দন। বাইরে অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চলে গেলেন নগর ভবনের ভেতরে, নিজের চিরচেনা কক্ষে। সেখানেও মন্ত্রী ইমরান এবং সস্ত্রীক উপস্থিত নতুন মেয়রের কাছ থেকেও পেলেন অভিবাদন। এরপরই বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আরিফ হস্তান্তর করলেন দায়িত্ব আর মেয়রের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন আনোয়ারুজ্জামান।
এসময় বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানান এবং আধ্যাত্মিক এই নগরীর উন্নয়নে সবসময় তার সহযোগিতার অঙ্গিকার করেন। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও তাকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে তার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহযোগিতা চান। এরপর বিদায়ী ও নব নির্বাচিত মেয়র চলে আসেন সুধী সমাবেশ মঞ্চে।
সুধী সমাবেশে আওয়ামী লীগের দেশ ব্যাপি উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সিলেটকে একটি তিলোত্তমা নগরে রূপান্তরের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, সিলেটকে একটি আধুনিক, স্মার্ট সিটি হিসেবে রূপান্তরের রূপকল্প বাস্তবায়নে সিলেট নগরবাসির সহযোহিতা প্রয়োজন। আধ্যাত্মিক ও পর্যটন নগর খ্যাত সিলেটের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আরো বেগবান করতে সকলের সহযোগিতায় তার পরিষদ যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। নগর উন্নয়নে বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সহযোগিতা কামনা করে তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বিগত ১০ বছরে সিসিকের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেন তিনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আমি মেয়র নির্বাচিত হলেও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আমি সিলেটবাসির মেয়র। নগর ভবন থাকবে রাজনীতি মুক্ত। নগরবাসি সবার জন্য নগর ভবন উন্মুক্ত থাকবে বলেও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
আর বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রীতির নগর সিলেট। গত ১০ বছর নগরবাসীর ভালোবাসার কাছে আমি চিরঋণী থাকবো। সবার ভালোবাসা ও সহযোগিতায় দুই মেয়াদ মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছি। সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে একটি জনবান্ধব নগর প্রতিষ্ঠায় নগরবাসির সহযোগিতা পেয়েছি। সিলেট সিটি কর্পোরেশন টানা ৪ অর্থবছরে কর্মসম্পাদন চুক্তির বাস্তবায়নে দেশ সেরা হয়েছে। নগরের সড়ক প্রসস্তকরণে সিলেটের নাগরিকরা হাজার হাজার কোটি টাকার নিজস্ব ভূমি দান করে দেশের ইতিহাসে বিরল এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। বিদায় বেলা আমি ভূমিদাতাগণ সহ সিলেটের উন্নয়নে যারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমার পরিষদ দুই মেয়াদে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের উর্ধ্বে উঠে নাগরিক সেবা ও উন্নয়ন কাজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় সিলেটের উন্নয়নে কখনো আপোষ করিনি। আজকের পর আমি মেয়রের দায়িত্বে থাকছি না। আমি আপনাদেরই মানুষ। যে অবস্থানেই থাকি না কেন সিলেটের উন্নয়নে আপনাদের আরিফকে পাশে পাবেন। নতুন পরিষদের প্রয়োজনে সবধরণের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নয়া মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে নগর পরিচালনায় কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন।
আরিফ তার বক্তব্যে অনেককে স্মরণ করেন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরমধ্যে ছিলেন, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম আবুল মাল আব্দুল মুহিত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, স্বাধীনতার পর সিলেট পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবরুল হোসেন বাবুল, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আ ফ ম কামাল, সিসিকের প্রথম মেয়র মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। এছাড়া ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান সিসিকের সকল কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
ওদিকে, প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বের পালাবদলের ইতিহাসে আজকের এই আয়োজনটি ঐতিহাসিক। বিদায়ী মেয়র সিলেটকে অনেক বদলে দিয়েছেন। রাস্তাঘাট প্রশস্থ করেছেন। অনেক উন্নয়ন করেছেন। তবুও সিলেট নগরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আরো অনেক কাজ করতে হবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের উত্তরসূরি নয়া মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেটকে উন্নত নগরে পরিণত করতে কাজ করবেন বলে আশাবাদ তার। তিনি বলেন, সিলেটের উন্নয়নে সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, আগামীতেও থাকবে।
শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং শহীদ স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। নতুন মেয়রের প্রতি নির্বাচিত বিশিষ্ট নাগরিকদের অনুভূতি ও প্রত্যাশা নিয়ে একটি ভিডিও প্রদর্শনী করা হয়। এতে সাবেক আওয়ামীলীগ দলীয় সংসদ সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্য দেখানো হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিমা ইয়াসমিন। বক্তব্য রাখেন সিলেট মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। তার অগোছালো বক্তব্য এবং মেয়র আরিফুল হকের নাম আরিফুজ্জামান বলা নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। জাকিরের পর বক্তব্য দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির খান। তার ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য প্রশংসা কুড়ায়। নাসির তার বক্তব্যে মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের প্রতি মেয়র নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হলেও তিনি সবার মেয়র একথা মনে করিয়ে দেন এবং নগরভবন যাতে দলীয় কুক্ষিগত না রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে সেই আহবান জানান।
সুধী সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান, সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরিফ, সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন, বিশিষ্ট শিল্পপতি ইকবাল আহমদ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক প্রমুখ।
সুধি সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, সিসিকের ৪২ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরগণ, সিলেটের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ, সিলেটের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর সংস্থার প্রতিনিধিগণ, নাগরিকবৃন্দ, সিসিকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে সম্মাননা তুলেন দেন সিসিকের বিদায়ি মেয়র ও নব নির্বাচিত মেয়র। বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবং মেয়র পত্নি হলি চৌধুরী বিদায়ী মেয়র পত্নি সামা হক চৌধুরীকে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি রজতকান্তি গুপ্ত ও জান্নাতুল নাজনীন। তবে অনুষ্ঠানস্থলে অব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সুধী সমাবেশ শেষে বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নব নির্বাচিত মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সহ সিসিকের সকল কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলরগণ, সিসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ তাঁর কুমারপাড়ার বাসভবনে শোভাযাত্রা করে পৌছে দেন।
এর আগে সিসিকের দায়িত্ব হস্তান্ত উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে ঐদিন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সহ নবনির্বাচিত কাউন্সিলরবৃন্দ বাদ জোহর হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন।
গত ২১ জুন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৫ম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আনোয়ারুজ্জামান মেয়র নির্বাচিত হন। পরে ৩ জুলাই মেয়র হিসেবে শপথ নেন। তবে মেয়র আরিফুল হকের মেয়াদ শেষ না হওয়ায় শপথের গ্রহণের প্রায় ৪ মাস পর তাকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। বিদায়ী মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী দলীয় সিদ্ধন্তে সেই নির্বাচনে অংশ নেননি।
গত ১০ বছরে আরিফ কাজ দিয়ে জয় করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সকলের মন। এবার দেখার পালা নতুন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান নিজে কতটুকু জয় করতে পারেন সবার হৃদয়।