তফসিল ঘিরে কৌতুহল, প্রশ্ন!
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ৯:৩৪:৪২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর ধারাবাহিক সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। এর পর সিইসি জানিয়েছেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত পদ্ধতিতেই’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। আর সর্বশেষ পরশু ইসি সচিব জানিয়েছেন এক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছে ।অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে ‘একতরফা’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছে তফসিল ঘোষণা করে ‘বিরোধী দলকে কাবু করতে সরকারের চেষ্টা সফল হবে না’।
এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের মাঝে এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সংবাদের মানুষের মাঝ নানা কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে।জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্ব গত বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের ওপর দৃশ্যমান চাপ প্রয়োগ করে আসছে।ইতোমধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনকে যারা ব্যাহত করতে চায় তাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব চাপ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে বিরোধী বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখেই ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তফসিল ঘোষণার পর আরও ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণা করতে পারে এমন ইঙ্গিতও তারা দিয়ে রেখেছেন।ফলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়-তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন, কৌতূহল ও আশঙ্কা আছে।বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ- এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিবিসিকে বলেছেন, তফসিল ঘোষণা করলেই যে নির্বাচন হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই, বরং তফসিল ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ নেয় তার ওপরই নির্বাচন হবে কি না বা কেমন হবে সেটি নির্ভর করবে।
অনুকূল পরিবেশ আদৌ আছে?
সিইসির নেতৃত্বে কমিশন সদস্যরা নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করলেও মাত্র ২০ দিন আগেই সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক কর্মশালার জন্য সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সে আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে একটি ধারণাপত্র দিয়েছিলো নির্বাচন কমিশন।তাতে কমিশন বলেছিলো যে “অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। প্রত্যাশিত সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি।বাস্তবতা হলো সেই পরিস্থিতির এখনো কোন উন্নতি হয়নি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় পক্ষ থেকেই সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।বিএনপি রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছে এবং বিএনপিকে মোকাবেলায় রাজপথেই অবস্থানের পথ বেছে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।
তফসিল দিলেই নির্বাচন নিশ্চিত?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পরেও বাতিল হয়ে যাবার উদাহরণ রয়েছে।সেবার বিএনপি তখনকার রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমদের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনড় থাকলেও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো শেষ মূহুর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে ওই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়।এরপর দু বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনে ছিলো দেশ। পরে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট।প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো এখন দৃশ্যত নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টার দিকেই হাঁটছে বলে মনে করেন তিনি।
যা বলছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত :
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। দলটি বলছে নির্বাচনের জন্য দলীয় কার্যক্রমের প্রস্তুতিও তারা শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দলের বৈঠকে নির্বাচন কেন্দ্রিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠনও হয়ে গেছে।দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আমরা নির্বাচনেই আছি। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে, সেখান থেকেও একটি দিক নির্দেশনা আসবে। তবে হয়তো এর চেয়ে ভালো পরিবেশে নির্বাচন হতে পারতো। কিন্তু ২৮ তারিখ বিএনপি তা-ব করে সেই পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে।
অন্য দিকে বিএনপি ও জামায়াত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকেই ছুটির দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করে আসছে।এ সপ্তাহেও অর্থাৎ আজ রবি ও কাল সোমবার আবারো সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ আব্দুল মঈন খান বলছেন, সরকার ভাবছে এভাবে একতরফা তফসিল দিয়ে বিরোধী দলকে কাবু করবে কিন্তু সেটি হবে তাদের জন্য দুরাশা। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এরকম তফসিল ঘোষণার উদাহরণ আমরা অনেক দেখেছি। তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তিত হয়েছে, সে উদাহরণও আছে। শুধু তাই নয়, তফসিল ঘোষণার পর যে নির্বাচন হবার কথা, সেই নির্বাচন সম্পূর্ণ বাতিল হবার উদাহরণও দেখেছি।মঈন খান বলেন, ২০২৪ এ এসে এখন সরকার আর দেশে-বিদেশে কাউকে বোকা বানাতে পারছে না। কারণ তাদের ‘অলটারনেট গণতন্ত্রের’ ফানুস ইতোমধ্যেই ফেটে ভেতরের গ্যাস বের হয়ে চুপসে গেছে।
এদিকে, বিএনপির মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও অভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে গত কিছু দিন ধরে। এ প্রসঙ্গে পরশু একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম বলেছেন, জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জেলে রেখে দেশে কোনো নির্বাচন জনগণ হতে দেবে না। জনগণের অধিকার আদায়ে সকল বিরোধীদল রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দেশের জনগণও বিরোধী দলের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় সরকার ভীত হয়ে বিরোধী মত দমনে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ও প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়েছে। জামায়াতসহ সকল বিরোধী দল ও মতের লোকদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। অসংখ্য ভাইদেরকে আহত করা হয়েছে।
এ অবস্থায় ইসিও অনড় সংবিধান অনুসারে নির্বাচন আয়োজনে। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন মূলত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাত করে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতির বিষয়টি তুলে ধরেন। পরে সিইসি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত পদ্ধতিতেই’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুতই তফসিল ঘোষণা করা হবে।
নির্বাচন ঘিরে সরকার, আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা দল এবং সিইসির অনড় অবস্থানের কারণে এখন মানুষের মাঝে নানা কৌতুহল ও প্রশ্ন। কি হতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে।
কৌতুহল আরো বেড়েছে শুক্রবার সিইসির একটি বক্তব্যেও। তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের চেয়ে নির্বাচন বড়’।