যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যঘোষিত শ্রমনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন গার্মেন্টস মালিকগণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ৮:৩৮:৫৬ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: গত কয়েক মাস ধরে কমছে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানীর হার। এরমধ্যে সদ্যঘোষিত শ্রমনীতি নিয়ে নতুন শঙ্কায় গার্মেন্টস শিল্পমালিকরা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা ছিল আগে থেকেই। এর মধ্যে অনেকটা আকস্মিকভাবেই ‘শ্রম অধিকার লঙ্ঘনকারীদের’ বিরুদ্ধেও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, ভিসা বিধিনিষেধসহ শাস্তিমূলক পদক্ষেপের নির্দেশনা জারি করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক এ সংক্রান্ত এক স্মারকে গত বৃহস্পতিবার সই করেছেন তিনি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ওইদিন এক ঘোষণায় বিষয়টি জানানোর পর থেকেই ভীত হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বিষয়টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
স্মারক জারির ঘোষণা দেয়ার সময় অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছিলেন, এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, ইউনিয়ন নেতা, শ্রম অধিকার রক্ষাকারী ও শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদের জবাবদিহি করতে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক জরিমানা এবং ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। আমরা কল্পনা আক্তার নামে বাংলাদেশী এক গার্মেন্ট কর্মীর মতো মানুষদের সঙ্গে থাকতে চাই। তিনি বলেছেন, মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করেছে বলেই তিনি এখনো বেঁচে আছেন।
বিষয়টি নিয়ে দেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতির পর শ্রম অধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেয়া বক্তব্যটি এখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনাপ্রবাহের পর ঘোষিত এ স্মারক এখন উদ্যোক্তাদের নতুন করে ভীত করে তুলছে।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানিকারক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তারাই এখন আতঙ্কে আছেন সবচেয়ে বেশি। এমনই এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘শ্রমিক অধিকারের মাপকাঠিতে দেখলে বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শঙ্কিত হয়ে ওঠার মতো অনেক কারণ রয়েছে। কোনো দেশ বা কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্য বা পদক্ষেপ আগে থেকে বোঝা মুশকিল। ভূরাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে। অনেকে মনে করছেন যে রাজনৈতিক এ টানাপড়েনকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিতে পারে। এটা নিয়ে ভীতি তো কাজ করছেই।
উদ্যোক্তারা বলছেন, রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর পশ্চিমা ক্রেতা ও শ্রমিক সংগঠনের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সুপারিশের ভিত্তিতে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন তারা, এখনো করে চলেছেন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ঘোষণা তাদের মধ্যে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। কারণ সব কারখানার পরিস্থিতি সমান নয়। এর মধ্যে গুটিকয়েক কারখানার পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে গোটা পোশাক খাতের ওপর কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে তা বড় ধরনের বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।
চট্টগ্রামভিত্তিক ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও শ্রম সংস্থার জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স যা করতে বলেছে, আমরা তা করেছি। ক্ষেত্রবিশেষে বেশিও করা হয়েছে। এখন সামাজিক অস্থিরতার নামে যদি শ্রমিক আন্দোলন হয়, আর সেখানে যদি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে; তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে-ই থাকুক সে তো তার কাজ করবে। এর ফলে যদি স্যাংশন দেয়া হয়, তাৎক্ষণিকভাবে প্রথমেই তার প্রভাব পড়বে শিল্পোদ্যোক্তাদের ওপর।
মার্কিন বাজারকে লক্ষ্য করেই কারখানার শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন এক উদ্যোক্তা। বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পোশাক রফতানি করে তার প্রতিষ্ঠান। এর ৮৫ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ওই উদ্যোক্তা বলেন, ‘তাজরীন, রানা প্লাজার বিপর্যয়পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় মার্কিন বাজারের পোশাক ক্রেতাদের লক্ষ্য করেই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছি। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি। শ্রম আইন পরিপালনসহ তা পর্যবেক্ষণেও বিনিয়োগ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক ঘোষণায় আমি ভীত। কারণ আমার কারখানায় শ্রম অধিকার উন্নত এবং তা নিয়ে আমার তেমন উদ্বেগ নেই। কিন্তু দেশের সব পোশাক কারখানার শ্রম অধিকার পরিস্থিতি এক নয়। অনেক কারখানায় এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি আছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখন এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি শ্রম অধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো ধরনের স্যাংশন দেয়, তাহলে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটিইএক্সএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্ববাজার থেকে ৯ হাজার ৯৯৩ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৯৭৪ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা মোট পোশাকের ৯ দশমিক ৭ শতাংশের জোগান দেয় বাংলাদেশ।
একক দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পোশাক রফতানির বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে ৪ হাজার ৫৭০ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৯০৫ কোটি ৯৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ হিসাবে মোট পোশাক রফতানির প্রায় ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য প্রযোজ্য নয় দাবি করে পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা বলছেন, এখানে কারখানাগুলো পরিচালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন মেনে। সরকারি-বেসরকারি অনেক ধরনের নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এদেশে শিল্প পরিচালনা করতে হয়। শ্রম আইন লঙ্ঘনের কোনো প্রশ্নই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘ভয়-ভীতি অবশ্যই আছে, কারণ রফতানিকারকরা পোশাক পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন না, করেন আন্তর্জাতিক বাজারে। ফলে কোনো বাধা এলে সেটার জন্য মুশকিল হওয়ারই কথা। আমি মনে করি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যে যার কাজটি ঠিকমতো করলে, আইন মেনে চললে ঝামেলার কোনো কারণ থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যারা শ্রম আইন মানবে না, শ্রমমান নিয়ন্ত্রণ করবে না তাদের শাস্তি হবে। অর্থাৎ যারা আইন মানবে, শ্রমমান নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।’
দ্য আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএলসিআইও) অধিভুক্ত আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার সংস্থা সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম বলেন, ‘পোশাক খাতে নি¤œতম মজুরির বিষয়টা যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করা হয়নি। এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত। শ্রমিক অধিকার ইস্যুতে চারজন শ্রমিক মারা গেছেন, এটা নজিরবিহীন। সে দৃষ্টিতে এখন অনেক কিছুই ইতিবাচক নয়।’
অ্যান্টনি ব্লিংকেনের বৃহস্পতিবারের ঘোষণায় উল্লিখিত ওই বাংলাদেশী শ্রমিক কল্পনা আক্তার এখন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘যে পলিসি নেয়া হয়েছে সেটা আমার দেশের না, যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন লেবার পলিসি। এটা সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার নাম কেন নিয়েছেন সেটা তিনিই ভালো জানেন। আমার নাম ও ঘোষিত পলিসির কোনো সম্পর্ক নেই। পলিসিতে মূলত শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বলা হয়েছে। এটি বাংলাদেশে লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা, সেটাই বড় বিষয়। পলিসি সব দেশের জন্য, শুধু আমাদের জন্য নয়। এখন আমাদের এখানে যদি লঙ্ঘনের ঘটনা থাকে, তাহলে ভয়ের বিষয় থাকবেই।’