সিলেটেও বিষাক্ত সিসা!
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ৮:৪৫:২৩ অপরাহ্ন
গড় মাত্রা ৮ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম, ৮৪ ভাগ শিশুর রক্তে সিসার অস্তিত্ব
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটে অতিমাত্রায় বিষাক্ত ধাতু সিসায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে ভয়াবহ তথ্য মিলেছে। ব্যাটারী তৈরির কারখানা বা অন্যান্য শিল্প কারখানা কম থাকা সত্ত্বেও সিলেটে সিসার গড় মাত্রা ৮ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটার। যা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা সিডিসি কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।ইউনিসেফ জানিয়েছে, গত বছর সিলেটের ২৪৮ জন শিশুকে নিয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়। তাদের শরীরে সিসার মাত্রা পরিমাপ করা হয়। পরীক্ষায় ৮৪ ভাগ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে। এসব শিশুদের রক্তে সিসার গড় মাত্রা ৫ দশমিক ৬৩। যা সিডিসি নির্ধারিত ৩ দশমিক ৫ মাত্রার চেয়ে বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা সিসায় বেশি আক্রান্তের কারণ তাদের রক্তে ৪-৫ গুণ বেশি সিসা শোষিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সিলেটের শিশুরাও রয়েছে অধিক ঝুঁকিতে।
সিলেট ছাড়াও টাঙ্গাইল, খুলনা, ও পটুয়াখালী জেলার শিশুদের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। পরীক্ষার আওতায় আসা ৯৮০ শিশুর সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রক্তে সীসার কোন নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রা নেই, অর্থাৎ যেকোন পরিমাণ সীসার উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আর কালক্ষেপণের উপায় নেই, জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সিসা দূষণে আক্রান্ত শিশুকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় মানসিক ও শারীরিক বিকাশবিহীন এক অভিশপ্ত জীবনের দায়।
সিসা কি : সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন যা শিশুদের মস্তিস্কের অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটা একধরনের বিষাক্ত ধাতু। জৈব এবং অজৈব যেকোন ধরনের রাসায়নিক পদার্থর সাথে একত্রিত হয়ে সিসা যৌগ তৈরী করতে পারে। সিসা জাতীয় কোন পদার্থ খনন করলে বা পোড়ালে খুব সহজেই সিসা দূষণ হয়ে থাকে। কারখানা, যানবাহন রঙ এবং অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের সময় এখান থেকে প্রচুর পরিমাণ সিসা নির্গত হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়, যা একটি পুরো অঞ্চল বা ঐ এলাকায় বসবাসকারী মানষদের প্রভাবিত করতে পারে।
সিসা কেন অভিশাপ?
যখন কোনো ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় সিসার সংস্পর্শে আসে, তখন তার মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেগুলো হলো তলপেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচি, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হাত বা পায়ে ব্যথা ইত্যাদি। এগুলো হয়তো সাময়িক। তবে নিয়মিত সিসার সংস্পর্শ জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধির কারণ হতে পারে।বিশেষ করে মস্তিষ্ক, যকৃৎ (লিভার) ও কিডনির ক্ষতি করে সিসা। অনেক বিশেষজ্ঞ অতিরিক্ত মাত্রায় সিসা ক্যানসারের কারণ বলে মনে করেন। বুদ্ধ্যঙ্ক বা আইকিউ হ্রাস করে এটি। বিশেষত শিশু, কিশোরদের জন্য সিসা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। গর্ভবতী নারী ও গর্ভের ভ্রূণের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় এটি। তা ছাড়া গর্ভবতী নারীর রক্তে অতিরিক্ত সিসা অপরিণত শিশু জন্মের কারণ হতে পারে।
এদিকে, ‘সীসা দূষণ বন্ধ হলে, বাড়বে শিশু বুদ্ধি বলে’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পরিস্থিতি অবহিত করার জন্য বুধবার সিলেটের সাংবাদিকদের নিয়ে একটি অবহিতকরণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সিলেট জেলা সিভিল সার্জন অফিস আয়োজনে এতে সহায়তা করে ইউনিসেফ সিলেট ফিল্ড অফিস।
সিলেট জেলার সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, ইউনিসেফ এর সিলেট বিভাগের চীফ অব ফিল্ড কাজী দিল আফরোজা ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা.জন্মেজয় দত্ত ও ইউনিসেফ সিলেট ফিল্ড অফিসের স্বাস্থ্য অফিসার ডা. মির্জা ফজলে এলাহী।মেডিকেল অফিসার-সিভিল সার্জন অফিস, ডা. স্বপ্নীল সৌরভ রায় এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন ডা. স্নিগ্ধা তালুকদার ও ডা. তনুশ্রী তালুকদার।
কর্মশালায় জানানো হয়, বিশ্বে প্রতি তিন জন শিশুর একজন সিসা দূষণের শিকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ৬০ শতাংশ এবং প্রায় তিন কোটি ষাট লক্ষ শিশুর রক্তে সীসার মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটার এর বেশি। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ আক্রান্ত দেশ। ইউনিসেফ এর সহায়তায় আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে ২০২২ সালে সিলেটের ২৪৮ জন সহ টাঙ্গাইল, খুলনা ও পটুয়াখালীর সর্বমোট ৯৮০ জন বাচ্চার রক্তে সীসার মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
পরীক্ষায় প্রত্যেকের নমুনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া যায়, যেখানে গড় মাত্রা ছিল ৫.৬৩ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটার। যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা সিডিসি কর্তৃক নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও বেশি।অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সীসার উৎস সম্পর্কে আরও জানার জন্য এই বছর এই বাচ্চাদের বাসা বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের খাদ্য পণ্য ও ব্যবহার্য জিনিসপত্রের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং আগামী বছর পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করা হবে।
মূল প্রেজেন্টেশনে বলা হয়, শিশুরা সবচেয়ে বেশি সীসা দূষণের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় যা অনেক ক্ষেত্রেই আর নিরাময় করা সম্ভব নয়। সীসা দূষণের ফলে শিশুদের নানান শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি আইকিউ কমে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এতে মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়ে শিশুরা লেখাপড়ায় দুর্বল হয় যা ভবিষ্যতে তাদের অনেক আগ্রাসী করে তোলে ও পরিপূর্ণ বিকাশের সক্ষমতাকে ব্যাহত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বুদ্ধি ভিত্তিক পঙ্গুত্বের পেছনে ৭০ ভাগ সীসা দূষণ দায়ী বলে জানানো হয়েছে।
সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের আয়োজনে ইউনিসেফের সহায়তায় ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানকারি, চিকিৎসক, শিক্ষক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিনিধি, কিশোর কিশোরী ক্লাব প্রশিক্ষক ও সদস্যদের নিয়ে একাধিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে যার মাধ্যমে ৪৬০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৭ টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৭ টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, ৫০ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৮ টি কিশোর কিশোরি ক্লাব, ইপিআই সেন্টার, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, সদর উপজেলার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী ক্লাব এর মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা সভার আয়োজন করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের নিয়ে আরও কর্মশালার আয়োজন করা হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।