ক্বীনব্রিজের ‘ঠেলাওয়ালা’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:০৪:৩৪ অপরাহ্ন

ছবি: ফাইল ছবি (সংগ্রহ)
মুনশী ইকবাল : সিলেটের ঐতিহ্যের কথা বললে চলে আসে ক্বীনব্রিজের কথা। এই ক্বীনব্রিজের কথা মনে হলেই চলে আসে ঠেলাওয়ালাদের কথাও। কয়েক যুগ ধরে এই ব্রিজের সাথে জড়িয়ে আছে এই ঠেলাওয়ালাদের নাম। সুরমা নদীর বুকে উত্তর ও দক্ষিণ সুরমাকে এক নাড়ীতে বেঁধেছে ক্বীনব্রিজ। দুইদিকে অনেকটা খাড়া ঢালু হওয়ায় এই ব্রিজ দিয়ে রিকশা চলাচল ছিল বেশ কঠিন। আর মালামাল বা একাধিক যাত্রী নিয়ে একা রিকশাচালকের পক্ষে এই ব্রিজের ঢালু বেয়ে ওঠা ছিল অসম্ভব। রিকশাচালকদের এই অসম্ভব কাজ সহজ করে দিতেন ঠেলাওয়ালারা। তারা রিকশা কিংবা ভ্যান বা ঠেলাগাড়ির পেছনে ধাক্কাদিয়ে ব্রিজের মাঝখানে পৌঁছে দিতেন। ব্রিজের দুইদিকে প্রায় অর্ধ শতাধিক ঠেলাওয়ার অবস্থান থাকতো। শুরুতে দুইটাকা, পরে পাঁচ টাকা, সর্বশেষ ঠেলা প্রতি দশটাকা নিতেন এই ঠেলাওয়ালারা। এই টাকায়ই চলতো তাদের জীবন জীবিকা। ধাক্কার সিলেটের আঞ্চলিক প্রতিশব্দ ঠেলা। এই ঠেলা থেকেই তাদের নাম দিয়েছেন স্থানীয়রা ঠেলাওয়ালা। কিশোর থেকে নিয়ে বৃদ্ধ নানান বয়েসের ঠেলাওয়ালারা এই ধাক্কার কাজ করতেন। একেকজন প্রতিদিন সত্তর থেকে আশি-নব্বইবার এই কাজ করতে পারতেন। কাক ডাকা ভোর থেকে গভীররাত পর্যন্ত চলতো তাদের ঠেলার কাজ। ফাঁকে সেরে নিতেন বিশ্রাম, আহার। সাধারণত যারা কোনো কাজ খুঁজে পেতেন না এবং পড়াশোনাও নেই তারাই এই ঠেলার কাজে জড়িয়ে পড়তেন। কোনো নিয়মের বালাই না থাকায় যে কেউ যেকোনো জায়গা থেকেই এসে এই কাজে লেগে যেতে পারতেন। মন্দা পীড়িত এলাকার লোকজন ছিলেন এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
তবে গত ২১ ডিসেম্বর ক্বীনব্রিজ খুলে দেওয়ার পর সেই চিরচেনা চিত্রের দেখা মিলেনি আর। চলতি বছরের ১৫ আগস্ট ব্রিজ মেরামত, নবায়নসহ নির্মাণকাজের জন্য ব্রিজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই মাস পর তা খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় চলে যায় চার মাস। সময় বাড়ানো হয় পাঁচ দফা। অবশেষে ২১ ডিসেম্বর খুলে দেওয়া হয় ক্বীনব্রিজ। তবে এই ব্রিজ দিয়ে এখন কেবল হেঁটেই পারাপার হওয়া যাবে। ব্রিজের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব ধরনের যান চলাচল। লোকজন ছাড়া কোনো যান যাতে ব্রিজে উঠতে না পারে তাই মাঝখানে দেওয়া হয়েছে খুঁটি।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জানান, ব্রিজটি সওজের অধীনে থাকলেও সংস্কার কাজ করেছে রেলওয়ে বিভাগ। সংস্কার কাজ করতে গিয়ে নতুন করে আরো কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে যায়। ফলে সংস্কার কাজে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফর শেষ হওয়া মাত্রই ব্রিজটি খুলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ব্রিজ দিয়ে শুধু জনসাধারণ চলাচল করতে পারবে।
ক্বীনব্রিজে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে ঠেলাওয়ালাদের জীবিকাও। অনেকেই এরই মধ্যে বিকল্প কাজ খোঁজা শুরু করেছেন। কেউ কেউ অপেক্ষায় আছেন যদি এই সিদ্ধান্ত বদলে আবার যান চলাচল শুরু হয় সেই আশায়। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন। আশপাশে খোঁজ নিয়েও কেউ বলতে পারেন না তারা কে কোথায় আছেন। তবে কোতোয়ালী থানার পাশে এক ভিক্ষুকের সাথে দেখা হয়। শুক্কুর আলী নামে এই মধ্য বয়স্ক জানান তিনি ঠেলার কাজ করতেন। শুরুতেই ব্রিজ বন্ধ হওয়ায় তার কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ভিক্ষায় নামেন। আর কোনো কাজ শেখেননি, তাই এটাই করেন। এখন এই এলাকায় থাকেন না। মাঝেমধ্যে পুরানো স্মৃতি মনে করে দেখতে আসেন। আজও তাই এসেছেন। তবে তার কোনো ঠিকানা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন একসময় দিনে সত্তর থেকে একশোটি পর্যন্ত ঠেলার কাজ করতাম। আয় হতো ৮শ থেকে একহাজার। এখন ভিক্ষা করেও খুব একটা খারাপ চলছে না।
এদিকে ক্বীনব্রিজে যানচলাচল বন্ধ করে কেবল হেঁটে পারাপারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। তারা বলছেন ক্বীনব্রিজ আমাদের একটি ঐতিহ্য। তাছাড়া যান দিয়ে চলাচলের জন্য শাহজালাল ব্রিজ ও কাজিরবাজার ব্রিজ প্রায় কাছাকাছি এবং নগরীর মধ্যেই। তাই ক্বীনব্রিজে যান চলাচল বন্ধের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যৌক্তিক। এরআগেও একবার এরকম সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিন্তু আশপাশের কয়েক এলাকার লোকজনের বাঁধায় কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এবার যেন সেরকার কিছু করার সুযোগ কেউ না পায় সেই বিষয়ে খেয়াল রাখার পরামর্শ তাদের। তারা বলেন ব্রিজে যান চলাচল বন্ধ করে হেঁটে পারপারের সুবিধা করা হয়েছে ঠিক কিন্তু যান বন্ধ করে ব্রিজে যাতে হকার মার্কেট চালু না হয়ে যায় সেদিকে কঠোর থাকতে হবে। পাশাপাশি এই ব্রিজে যান চলাচল কেন্দ্র করে যেসব মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল ছিল তাদের পুনর্ভাসনের জন্যও সংশ্লিষ্টদের চিন্তা করতে হবে।