সালতামামি ২০২৩ : ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়ের রেকর্ডভাঙা বছর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:৩৮:০৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ঘটনা-দুর্ঘটনা ও রাজনীতির জন্য আলোচিত ২০২৩ বিদায়ের পথে। কিন্তু এ বছর অনেকটা ভূমিকম্প ও প্রকৃতিক দুর্যোগের বছর হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে।
ভূমিকম্প:আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর দেশে ৫ মাত্রার ওপরে মোট ৬টি ভূমিকম্প আঘাত করেছে। এর আগে ২০২২ সালে মাঝারি মাত্রার বা রিখটার স্কেলে ৫-এর ওপরে মোট তিনটি ভূমিকম্প হয়। অথচ ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কটি ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে মাঝারি মাত্রার কম্পনের ঘটনা ঘটেছে প্রতি দুই থেকে চার বছরে একবার। আর এ বছর ৪ থেকে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে মোট ৪৮টি। নিয়মিত ওই কম্পন সিলেটসহ বড় শহরগুলোর জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা অবশ্যই বাড়ছে। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো আমাদের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ফাটলরেখায় ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের বিপদ সম্পর্কে আভাস দিচ্ছে। আমাদের এ জন্য ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও সাবধানী হতে হবে। দেশের বিদ্যমান নিয়ম ও ভবন নির্মাণ নীতিমালা মানতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়: ১৯৭১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করত, সেখানে ব্যতিক্রম ২০২৩ সাল। এ বছর রেকর্ড ভেঙে চার চারটি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের ওপরে প্রভাব ফেলেছে।যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট গত অক্টোবরে ‘অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।
এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর। ৬৫ বছর কিংবা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে তাপজনিত মৃত্যু ১৪৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ১ হাজার ৪৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গবেষণাটিতে মূলত ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপরে আঘাত হানা দুর্যোগগুলোর তথ্য নেওয়া হয়েছে। তবে গবেষকেরা মনে করছেন, এ বছরের আবহাওয়ার বিপদের তথ্যগুলো যোগ করলে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বৃদ্ধির হার আরও বাড়বে। আর বিশ্ব আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ডব্লিউএমও আরও এক কাঠি এগিয়ে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের চেয়েও ২০২৪ সালের আবহাওয়া আরও ভয়ংকর ও চরমভাবাপন্ন আচরণ করতে পারে। এতে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের বিপদ তো বটেই, রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও বাড়তে পারে।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেশের দুর্যোগগুলোর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব রাখার ব্যবস্থা করছি। যাতে এসব দুর্যোগ যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে, তার প্রমাণ আমরা দিতে পারি। জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিল এবং সর্বশেষ লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড বা জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি তহবিল থেকে অর্থ পেতে সুবিধা হয়।’
বজ্রপাত: ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইইডি) একটি গবেষণার বরাত দিয়ে চলতি বছরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্রামীণ বসতি বন্যার কবলে পড়ে। আর প্রায় ৪১ শতাংশ বসতি ঝড়ের আঘাতের শিকার হয়।
প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ দাবদাহ, বজ্রপাত ও শৈত্যপ্রবাহের মতো দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে প্রায় তিন মিটার উঁচুতে থাকা হাওর এলাকায় কয়েক বছর পরপর হঠাৎ বন্যা হয়। এর বাইরে খরা ও উপকূলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও বাড়ছে। খুলনা এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার উঁচুতে হওয়ায় ঝড়বৃষ্টি হলে সেখানে জোয়ারের পানি উঠে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। প্রতিবছর তিন শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। নতুন এ দুর্যোগ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশে অবনতি হচ্ছে দাবদাহ পরিস্থিতিরও। গত বছর, মানে ২০২২ সালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণ বছর ছিল।
এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সব ধরনের দুর্যোগ বাড়ছে। বিশেষ করে বজ্রপাত ও তাপপ্রবাহের মতো নতুন ধরনের বিপদ দ্রুত বেড়ে ক্ষতি ও জীবনহানি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে বলা হয়, সব কটি দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশের ওই ক্ষয়ক্ষতির জন্য সহায়তা করা দরকার বলে মত দেওয়া হয়।
এ ব্যপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাবকে এত দিন আমরা ভবিষ্যতের বিষয় মনে করতাম। যার কিছু লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে; কিন্তু এ বছর আমরা যেভাবে একের পর এক চরম আবহাওয়ার বিপদ দেখলাম, তাতে আমাদের মনে রাখতে হবে, এ অবস্থাটা সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে।