সালতামামি-২০২৩ : বছরজুড়ে ‘ছিনতাই-ডাকাত’ আতঙ্ক প্রাণ হারান সবজি বিক্রেতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ৬:২৬:১২ অপরাহ্ন
প্রায় দেড় শতাধিক ঘটনায় আহত অনেক
এ টি এম তুরাব : চলে গেলো দুই হাজার তেইশ। বছরটির পুরোটা সময়জুড়ে সিলেটবাসীর জন্য আতঙ্কের নাম ছিল ‘ছিনতাই-ডাকাতি’। বিদায়ী বছরে নগরের অলিগলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। গত এক বছরে সিলেট নগরীতে ছোট-বড় প্রায় দেড় শতাধিক ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছেন এক সবজি বিক্রেতা। আহত হয়েছেন অনেকে। এসব ঘটনায় অনেকে মোবাইলসহ টাকা-পয়সা খুইয়েছেন। এর বেশিরভাগ ঘটনায় থানায় কোন মামলা হয়নি।
এদিকে, ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নগরে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে মহানগর পুলিশ (এসএমপি)। এতে বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকেও গ্রেফতার করা হয়। তবে কমেনি ছিনতাইয়ের ঘটনা। গ্রেফতারকৃতরা কয়েকমাস জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের জড়িয়ে পড়ে পুরোনো পেশায়। এতে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দেয়।
আলোচনায় ছিল সবজি বিক্রেতা : গত ১ জুন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নগরীর ধোপাদীঘির পারে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গোবিন্দ দাস (৩৩) নামে এক ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা নিহত হন। প্রতিদিনের মতো ওইদিন ভোরে সবজি কিনতে নগরের সুবহানীঘাট কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন গোবিন্দ। পথে ধোপাদীঘির পাড়ের শিশুপার্কের সামনে গেলে কয়েকজন ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে টাকা লুট করে নিতে জোর করে। এ সময় তিনি বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা গোবিন্দকে ছুরিকাঘাত করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা রক্তাক্ত অবস্থায় গোবিন্দকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ খুনের দৃশ্য ধরা পড়েছে ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজে। পরে পুলিশ পাঁচ ছিনতাইকারীকে শনাক্ত করে তাদের গ্রেফতার করেছিলো।
জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই ৮ মাসে পুরো সিলেট মহানগরে ডাকাতি ৮টি, ছিনতাই ৫৬টি ও ১৫১টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ১১ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ সুরমা থানাধীন গোপশহর এলাকার খানবাড়িতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি ডাকাতদল হানা দেয়। এ সময় তারা লুটপাটের পাশাপাশি বাড়ির লোকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের আহত করে। আহত হয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিনজন। ডাকাতদের আঘাতে একজনের দাঁত ভেঙে গেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে একই উপজেলার সিলাম এলাকায় টিকরপাড়ায় ঘরের গেট ভেঙে এক কুয়েত প্রবাসীর বাড়িতে ১০ থেকে ১২ সদস্যের এক ডাকাতদল তা-ব চালায়। ঘরের মানুষদের বেঁধে অত্যাচার করে টাকা স্বর্ণালংকার ও একটি টিভিএস মোটরসাইকেল লুট করে নিয়ে যায়।
১২ সেপ্টেম্বর নগরীর বালুচর এলাকায় এক ফ্রিল্যান্সারের ওপর হামলা চালিয়ে ১৮ লাখ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ১০ সেপ্টেম্বর নগরীর তালতলা এলাকা থেকে এক সৌদি প্রবাসীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে হত্যার হুমকি দেয় তারা। পরে নগরীর কুয়ারপার এলাকা থেকে ওই সৌদি প্রবাসীকে উদ্ধার করে পুলিশ।
নিয়ন্ত্রণে আসছে না ছিনতাই: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে কারাগারেও পাঠিয়েছে। তবে, এসএমপির এমন নড়েচড়ে বসাতেও কাজ হয়নি। নগরজুড়ে এখনও ছিনতাইকারীদের উৎপাত রয়ে গেছে। আগের চেয়ে কিছুটা কম হলেও মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সিলেট নগরের রাস্তা এখনও অনিরাপদ সাধারণ মানুষের জন্য।
ছিনতাইয়ের হটস্পট: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নগরীতে ছিনতাইয়ের হটস্পট রয়েছে প্রায় ২০টি। বছরজুড়ে এসব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে এসএমপির উত্তর বিভাগ ছিল সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ। এ বিভাগের অধীন এলাকাতে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সবজি বিক্রেতা নিহত। এছাড়া দক্ষিণ বিভাগেও বেশি কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় অনেকে আহত হন।
হটস্পটের তালিকায় রয়েছে, দক্ষিণ সুরমা, কদমতলী বাস টার্মিনাল, নগরের প্রবেশমুখ হুমায়ূন রশীদ চত্বর, রেল স্টেশন এলাকা, পুরান পুলের মুখ, উপশহর গলিরমুখ, সুবহানীঘাট, ধোপাদীঘিরপার, কীনব্রিজ, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, কোর্টপয়েন্ট, তালতলা, কাস্টঘর, লালদীঘির পার, মিরাবাজার, মেন্দিবাগ, জিন্দাবাজার, মেডিকেল রোড, লামাবাজার, শিবগঞ্জ, আম্বখানার, মির্জাজাঙ্গাল, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, বালুচর, টিলাগড়, শাহী ঈদগাহ, টিভি গেইট, কাজীটুলা, নয়াসড়ক, ইলেকট্রিক সাপ্লাই, বন্দরবাজারসহ ছিনতাইয়ের আরো কয়েকটি অন্যতম হটস্পট রয়েছে। এলাকাগুলোতে রয়েছে ছিনতাইকারীদের আলাদা আলাদা বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্র। এসব ছিনতাই পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফাঁড়ি পুলিশের সখ্যতা আছে। দীর্ঘদিন ধরে ফাঁড়িতে থাকা পুলিশের কয়েক সদস্য ঘুরেফিরে একই ফাঁড়িতে দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে তাদের সঙ্গে অপরাধীদের সখ্যতা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা হলো সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকা। মাদক, ছিনতাই, জুয়া, অজ্ঞান পার্টি, পকেট চোরের রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট চক্র। এখানে এমন কোন অপরাধ হয় না, এটি বলা মুশকিল। পুলিশ তালিকায়ও উপজেলাটি ক্রাইম জোন হিসেবে চিহ্নিত।
দক্ষিণ সুরমার পরেই হচ্ছে নগরের উত্তর অংশের উপশহর গলিরমুখ, মেন্দিবাগ, সুবহানীঘাট, ধোপাদীঘিরপার এলাকায় রয়েছে আরো একটি ছিনতাইকারীদের সিন্ডিকেট। এরা হচ্ছে নগরের কাস্টঘর কেন্দ্রিক ছিনতাইকারী চক্র। এছাড়া ক্বীন ব্রিজ এলাকায় রয়েছে ভাসমান ছিনতাই চক্র। ভোররাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের টার্গেট করে তারা। কীনব্রিজ, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, কোর্টপয়েন্ট, তালতলা এলাকায় তারা অবস্থান করে।
সুবহানীঘাটের সবজি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সবজির খুচরা বিক্রেতা ভোররাতে বাজারমুখী হন। এসময় তাদের সঙ্গে নগদ টাকাও থাকে। তারা সকালের মধ্যে মালামাল সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। এতে প্রায় ব্যবসায়ী ছিনতাইয়ের শিকার হন। এসব ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে ভুক্তভোগীরা উল্টো হয়রানীর শিকার হতে হয়।
নিরাপদ সিলেট চান নগরবাসী: কাল থেকে শুরু হচ্ছে নতুন বছর। এই নতুন বছরে নিরাপদ সিলেট চান মহানগরের বাসিন্দারা। তারা চান, দিন কিংবা রাত, যে কোনো সময় এ নগরের রাস্তা যেন নিরাপদ থাকে। আর যেন কেউ ছিনতাইয়ের শিকার না হন। নগরীর শাহজালাল উপশহরে বাসিন্দা দিদার হোসেন রুবেল দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা চাই নতুন বছরে উপশহরসহ পুরো নগরীতে আর কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা না ঘটে। ছিনতাইকারীদের হামলায় কাউকে যেন মরতে ও আহত না হয়, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
নগরীর যতরপুরের বাসিন্দা জাবুর আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, কাস্টঘর ও বন্দরবাজার এলাকায় মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের অনেক উৎপাত। নতুন বছরে আর এ উৎপাত দেখতে চাই না। সরকার ও প্রশাসন যেন আমাদের ছিনতাইমুক্ত একটি ঢাকা শহর উপহার দেয়, এটাই চাওয়া।সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) মুখপাত্র এডিসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে এসএমপির অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। নগরীকে ছিনতাইকারীমুক্ত করতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান হয়, এটি রুটিন ওয়ার্ক। নতুন বছরেও আমরা ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখব।