সালতামামি ২৩: নিত্যপণ্যের আগুনে দগ্ধ হওয়ার বছর
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:০০:০৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ২০২৩ সাল ছিল নিত্যপণ্যের আগুনে দ্বগ্ধ হওয়ার বছর। পুরো বছরই নিত্যপণ্যের বাজার ছিল অস্থিতিশীল। বছরজুড়ে রাত পোহালেই বাড়ছিল পণ্যের দাম। সবজি, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, ডিম-কোনোটির দামই স্থিতিশীল ছিল না। এমনিতেই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতিতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনচাকা থমকে রয়েছে। তার ওপর ধারাবাহিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ায় খেটে খাওয়া মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, মাছ-মাংস বা ডিম খাওয়ার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছিল মানুষজন।
কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের বাজার ছিল চড়া। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর হলেও সিন্ডিকেট পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি। এ কারণে বছরজুড়েই পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।
কাঁচা মরিচ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড :
চলতি বছর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল কাঁচা মরিচের দাম। গত জুলাই মাসে কেজিপ্রতি কাঁচা মরিচের দাম উঠে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। দেশের বাজারের ইতিহাসে কাঁচা মরিচের দাম এটিই সর্বোচ্চ।সবজি বিক্রেতারা বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে মরিচের সরবরাহ কমে যাওয়ায় হঠাৎ করে দাম বেড়ে যায়। তবে ক্রেতাদের দাবি, ইচ্ছে করেই কাঁচা মরিচের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে সরকারের কঠোরতা ও গোয়েন্দা সংস্থার নিয়মিত তদারকিতে মাসখানেক পর কাঁচা মরিচের বাজারে স্বস্তি আসে।
পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখে পানি:
বছরের শেষ দিকে এসে হঠাৎ করেই হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। খুচরা ও পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ২৮০-২৯০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। এতে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হিমশিম খায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে ভারত। এরপরই রাতারাতি বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। অবশ্য দেশি নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার পর দাম কিছুটা কমেছে।
ডিম কিনতে হিমশিম:
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও ডিমের বাজার ছিল অস্থিতিশীল। বিশেষ করে আগস্ট মাসের দিকে ডিমের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৬০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সরকার প্রতিটি ডিমের দাম বেঁধে দেয় ১২ টাকা করে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো ডিমের দাম রাখেন। গত সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে ডিম আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরপরই ডিমের বাজার স্থিতিশীল হয়।
গরুর মাংসে হাসফাঁস:
বছরের শুরুর দিকে গরুর মাংসের দাম ১ হাজার টাকা থেকে ১১শ টাকা পর্যন্ত উঠে। তখন মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এতে বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরে বাধ্য হয়েই দাম কমাতে বাধ্য হন তারা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৭ লাখ টন। দেশের বাজারে মাংসের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় ১১ লাখ টন বেশি মাংস উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও বাজারে দাম ছিল বেশি। কিন্তু মানুষ মাংস কেনা কমিয়ে দেওয়ায় দাম কমতে শুরু করে। বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
চালের চেয়ে বেশী আলুর দাম:
বছরের শুরুতে ২০-২৫ টাকায় এক কেজি আলু পাওয়া যেত। কিন্তু শেষ দিকে এসে আলুর দাম তিনগুণ হয়। দেশি আলুর দাম ৯০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর হয়। কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। বর্তমানে এক কেজি আলু ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। যা এক কেজি চালের দাম থেকেও বেশী।
চিনি নিয়ে ছিনিমিনি :
বছরজুড়ে চিনির বাজারে অস্থিরতা ছিল। নভেম্বর মাসে এসে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজি প্রতি ১৫০ টাকায় ওঠে। সরকার দফায় দফায় চিনির দাম বেঁধে দিলেও বাজারে তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা কমলেও দেশে এখনও চিনির বাজার চড়া। খোলা ও প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায়। অথচ বছরখানেক আগেও প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮০-৯০ টাকায়।
তেলবাজিতে অতিষ্ঠের বছর :
কয়েকদিন পরপরই বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। কোনোরকম ঘোষণা ছাড়াই তেলের দাম বাড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো। বাজারে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৩ টাকায়, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ১৬৯ টাকা। একইভাবে দাম বেড়ে প্রতি দুই লিটার তেলের বোতল ৩৩৮-৩৪৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম বেড়েছে ২০ টাকা।
উড়ন্ত সবজি বাজার :
কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। বছরজুড়ে সবজির বাজারের চিত্রও অনেকটা তাই। মুলা ও পেঁপে ছাড়া কেজিপ্রতি ৮০–১০০ টাকার নিচে ভালো মানের কোন সবজিই পাওয়া যায়নি। তবে ডিসেম্বর মাসে এসে সবজির বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। শীতকালীন সবজি বাজারে আসার পর বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা কমিয়েছেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন প্রতি কেজি শিম ও টমেটো ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি মাঝারি সাইজের ফুলকপির দাম ৪০-৫০ টাকা, যা অন্যান্য বছর ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাজারে বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। প্রতি পিস লাউ নেওয়া হচ্ছে ৭০-৯০ টাকা। মুলার কেজি এখন মোটামুটি ৪০ টাকা, শালগম ৫০-৫৫ টাকা। শীত আসার আগে সবজির উচ্চমূল্যের মধ্যেও যে পেঁপে ২০ টাকায় পাওয়া গেছে, তার দাম এখন ৩০-৪০ টাকা। কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০-১৩০ টাকায়। বাজারে প্রতি আঁটি শাকের দাম ২০ টাকার কমে মিলছে না।