নব ঝর্ণাধারায় জীবন হোক সিক্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ৫:৫৪:৪৪ অপরাহ্ন
বিদায় ২০২৩, স্বাগত ২০২৪
নিজাম উদ্দীন সালেহ :
প্রবাদ রয়েছে, সময় ও জোয়ার কারো জন্য অপেক্ষা করে না। প্রভাতে কলকাকলিতে উড়ে যাওয়া পাখির ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলতে না ফেলতেই সন্ধ্যা নামে। দিন আসে দিন যায়। একইভাবে ঝরা পল্লবের মতো ইংরেজী দিনপঞ্জিকার পাতা থেকে খসে পড়েছে ২০২৩, শুরু হয়েছে নববর্ষ ২০২৪। কবির ভাষায় ‘সঞ্চারিত হাজারো আশা হে শুভ নববর্ষ/আশা করি বিশ্বাসে আসবে শান্তি চিত্তে আসবে হর্ষ/বিগত দিনের গ্লানিময়তায় জীবন হয়েছে তিক্ত/তোমার নব ঝর্ণাধারায় করো এ জীবন সিক্ত।’
বিগত বছরে এদেশের জাতীয় জীবনে যেমন ঘটেছে বহু সুখ-দুঃখের ঘটনা, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গন আলোড়িত হয়েছে বিচিত্র সব ঘটনায়।
বলা বাহুল্য, এ বছরের প্রথম সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের কারণেই নতুন বছরটি যে দীর্ঘকাল আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সাধারণতঃ বিদায়ী বছর ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৩ সাল ছিলো একটি ঘটনা বহুল বছর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক চড়াই উৎরাই আর নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে গেছে বিগত বছর।
জাতীয় ক্ষেত্রে নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, রাজপথ দখল, সংঘাতই ছিলো বিদায়ী বছরের আলোচিত বিষয়। নির্বাচন ঘিরে সারা বছরই আলোচনায় ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকান্ড এবং ইইউসহ পশ্চিমা বিশ্বের বাংলাদেশ নিয়ে নানা বিবৃতি ও তৎপরতা।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধ ও গাজার যুদ্ধ ছিলো সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বর্তমানে রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের তীব্রতা অনেকটা হ্রাস পেলেও গাজার লড়াই আরো তীব্র হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। গাজার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ সংঘাত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এমনকি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করছেন সমর বিশ্লেষকরা। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বছরের শেষভাগে বিশ্বের ইতিহাসকে রক্তাক্ত ও কলংকিত করেছে।
বিগত ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের জন্য তীব্র মূল্যস্ফীতির বছর বললে অত্যুক্তি হবে না। গোটা বছর জুড়ে ছিলো বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা। মূলকতঃ বাজার কারসাজির কারণে দফায় দফায় বেড়েছে পেঁয়াজ, আলু, ডিম ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম। কখনো কখনো কোন কোন নিত্যপণ্যের দাম অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এই প্রবণতা নতুন বছরেও যে অব্যাহত থাকবে না, এর কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ রিজার্ভ ঘাটতি, ডলার সংকট ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের তীব্র চাপের ফলে নিত্যপণ্যের দাম আরো উর্ধ্বমুখী হওয়ার আশংকা রয়েছে। যদি বিদেশী বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, তবে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশংকাও করছেন অনেকে।
বিগত বছরে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। মেট্রোরেল, টানেলসহ বহু সড়ক ও সেতু তৈরী হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদায়ী বছর ছিলো মিশ্র প্রতিক্রিয়ার বছর। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণীতে তা করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ও মুখস্থ নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতানির্ভর পড়াশোনার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। শিক্ষাক্রমে এমন বিশাল পরিবর্তনে তুমুল আলোচনা ছিলো সারা দেশেই। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তব পটভূমি ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত।
বিগত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ছিলো আলোচিত বিষয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হন প্রায় সোয়া ৩ লাখ মানুষ। মৃত্যু হয় প্রায় ২ হাজার মানুষের। এছাড়া বছর জুড়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ছিলো আরোচনায়। ধর্ষণ, সহিংসতা, পারিবারিক নির্যাতন, হত্যার মতো ঘটনা ছিলো ক্রমবর্ধমান।
বিগত বছরজুড়ে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ভ্রমণকারী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের ব্যাপক তৎপরতা ছিলো দর্শনীয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশ গেছেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। এই ধারণা আগামী বছর জুড়েও চলতে পারে, এমনটি প্রত্যাশা করা যায়।
করোনা ও ইউক্রেইন যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে বিশ্ব এখন কিছুটা ঘুরে দাড়িয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থা নেতিবাচক। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করছেন সচেতন মহল। বিষয়টি ১৭/১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশের জন্য বড়োই দুঃখ ও বেদনার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি তথা দ্বৈত চরিত্র এখন তুমুল আলোচনা সমালোচনার বিষয়। একদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কথা বলছে দেশটি, অপরদিকে চরম নিষ্ঠুর ও নৃশংস ইসরাইলকে অস্ত্রশস্ত্র অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করছে নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যায়। বিষয়টি মানবতা ও মানবাধিকারের ইতিহাসকে কলংকিত ও কলুষিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন নেতিবাচক অবস্থানের ফলে প্রতিদিন শত শত মানুষ নিহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। অপরদিকে দেশটিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে।
সর্বোপরি, বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কী হচ্ছে, কী হবে, এই আশংকায় থর থর করে কাঁপছে চারদিক। এতো উত্তেজনা শংকা ও অনিশ্চয়তা সত্বেও এক নতুন শুভ ও সুন্দর দিনের প্রতীক্ষায় এদেশের মানুষ, বিশ্ববাসী। মানুষ আশাবাদী। আশাই জীবন। তাই এই আশার ডানায় ভর করে আগামী দিনগুলো পাড়ি দেয়ার ও সুন্দর ভবিষ্যত রচনা করতে চাই আমরা। মহান সৃষ্টিকর্তার করুণা চাই এক্ষেত্রে। নতুন বছর শুভ ও কল্যাণময় হবে এই প্রত্যাশা বিশ্ববাসী সকলের মতো আমাদেরও।