সিলেট ১ আসন : ভোটের মাঠে নেই চেনা দৃশ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫:৪০ অপরাহ্ন
# দেখা মেলেনা প্রার্থীদের, নেই আমেজ
# এটা যেন এক মরাবাড়ি : সুজন সভাপতি
মুনশী ইকবাল:
নির্বাচন মানেই এক উৎসবের আমেজ। অন্যান্য উৎসব আসে বছর বছর তবে নির্বাচন আসে পাঁচ বছরে একবার। আর সেই নির্বাচন যদি হয় জাতীয় নির্বাচন যার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তের সুযোগ আসে তবে তো কথাই নেই। ফলে স্থানীয় নির্বাচন তো থাকেই জাতীয় নির্বাচনে উৎসবে আমেজ আর আয়োজন থাকে কয়েকগুণ। নির্বাচন মানেই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় সড়ক থেকে অলিগলি। ছোটো ছোটো মিছিল থেকে নিয়ে হয় বিশাল গণসংযোগ। বাড়ি বাড়ি প্রার্থী ও সমর্থকদের আনাগোনা, পাড়ায় পাড়ায় নির্বাচনী অফিস, চায়ের দোকান থেকে মুদি দোকানে আলোচনার ঝড়, বাড়ির উঠোন থেকে ড্রইংরুম সবখানে জটলা বেধে মিটিং। একটা সময় এই ছিল চিরায়ত বাংলার নির্বাচনী চিত্র। কিন্তু এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সিলেট সদর বা সিলেট ১ আসনে নির্বাচনের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
এখানে দৃশ্যত নেই কোনো উৎসবের আমেজ, নেই সচরাচর নির্বাচনী প্রচারণা। দেখা মিলেনা প্রার্থীদের। একজন প্রার্থীর মাঝেমধ্যে লিফলেট বিতরণের ছবি ফেইসবুক ও পত্রিকার পাতায় দেখা গেলেও স্বশরীরে গণসংযোগে তাকে এখনও দেখেননি বেশিরভাগ মানুষ। তিনি কখন আনেন বা কখন যান তাও বুঝেন না কেউ। আর বাকি প্রার্থীদের দেখা তো দূরে থাক চেননই না কেউ। তারা জানেনই না প্রার্থী কয়জন। অনেকে সিলেটের এই নির্বাচনকে মরাবাড়ির সাথে তুলনা করেছেন। তারা বলছেন সিলেটে কেবল নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি মোমেন ছাড়া আর কারো পোস্টার চোখে পড়েনি। তাও শুধু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ও সড়কেই সেই নির্বাচনী পোস্টার সীমাবদ্ধ দেখা গেছে। বুধবার একটি পিকআপে করে কয়েকজন নারী ও কিশোরকে নৌকার প্রচারণা করতে দেখা গেছে।
এবারের নির্বাচনে সিলেট-১ (নগর-সদর) আসনে মূলত ফন্ট লাইনে আছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। মোমেন ছাড়া বাকি প্রার্থীরা হলেন ইসলামী ঐক্যজোটের ফয়জুল হক জালালাবাদী (মিনার), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ইউসুফ আহমদ (আম), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ সোহেল আহমদ চৌধুরী (ডাব) ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আবদুল বাছিত (ছড়ি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে নৌকার প্রার্থী মোমেন ছাড়া অন্যদের প্রচারণা দেখা যায়নি। নগরীর কোর্ট পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ দু একটি ব্যস্ত জায়গায় কেবল তাদের অল্প কয়েকটি পোস্টার ঝুলতে দেখা যায়। এদিকে এ কে আবদুল মোমেন পোস্টার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট ছাড়াও কিছু কিছু ব্যস্ত সড়কে ঝুলতে দেখা গেছে। তবে পাড়া মহল্লায় অন্যান্যবার নির্বাচনের আগে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেলেও এবার তা দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্বাচনী অফিসের চিত্রও। মাঝেমধ্যে দু একটি বাজারে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেলেও তা কয়েকমিনিটে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। লিফলেট বিতরণ বা নির্বাচনী প্রচারণার চেয়ে তাদের মধ্যে ফটোসেশনই মূখ্য ছিল বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সিলেটের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার শুরু থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। তবে সিলেটে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি আরও প্রার্থী থাকলেও তাঁদের সেই অর্থে কোনো তৎপরতা নেই। ওই প্রার্থীরা তুলনামূলকভাবে ভোটারদের কাছে অনেক অপরিচিত। ফলে অনেকটা একতরফা নির্বাচন হবে বলে মনে হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বলা ঠিক হবে না, তবে মনে হচ্ছে এখানে কোনো নির্বাচন নেই, এটা যেন এক মরাবাড়ি। মানুষ বলতে পারে না নির্বাচনে প্রার্থী কয়জন।
বিভিন্ন লোকজনের সাথে কথা বলে জানাগেছে এবারের নির্বাচনের মতো এত মরা নির্বাচন সিলেটে আর দেখা যায়নি। শুরুতে মোমেনের সাথে আওয়ামীলীগের তিনবারের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। মিসবাহ সিরাজ সিলেটের পরিচিত এবং আওয়ামী পরিবারের পরীক্ষিত মুখ হাওয়ায় অনেকেই মনে করেছিলেন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তবে ‘আচমকা’ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে আলোচনা থামিয়ে দেন মিসবাহ নিজেই।
মিসবাহ সিরাজ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ায় মূলত মর্যাদাপূর্ণ এই আসন থেকে উৎসবের আমেজও সরে যায়। পাশাপাশি বর্তমান এমপি এ কে আবদুল মোমেনও অনেকটা খালি মাঠে গোল দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হওয়ায় তাকেও প্রচারণায় দেখা যায় না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। মাঝেমধ্যে দু একজায়গায় হঠাৎ করে এসে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে মূলত তিনি রুটিন ওয়ার্কই করছেন বলে মত তাদের।
নির্বাচন বোদ্ধাদের অনেকেই জানিয়েছেন এই নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ জনসমর্থন আছে এরকম কার্যত কোনো দল ভোটের মাঠে নেই। তারা নির্বাচনের মাঠে থাকলে নির্বাচনের যে উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ তা দেখা যেত। মূল ধারার কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকায় মানুষের কাছে নির্বাচনের আবেদন হারিয়েছে। সিলেট ১ আসনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ছাড়া নির্বাচনে উৎসবের আমেজ বিরাজ করা দুষ্কর। কারণ এখানে এই দুইদলের ভোট ব্যাংক ও জন সমর্থন অনেক জোরালো। যার স্পষ্ট প্রভাব এবারের নির্বাচনী পরিবেশে দেখা যাচ্ছে।
একই বক্তব্য অনেক সাধারণ নাগরিকদেরও। বন্দরবাজারের পুস্তক ব্যবসায়ী শফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচন দেখতে দেখতে চুল পাকিয়ে ফেললাম, কিন্তু সিলেটের এবারের মতো নির্বাচন আর দেখিনি। নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। এরচেয়ে বিগত সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনেক উৎসবমুখর ছিল। এটা যে কোনো জাতীয় নির্বাচন তা বুঝাই যাচ্ছেনা। নির্বাচনে শুধু আওয়ামীলীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ছাড়া আর কোনো প্রার্থী আছেন বলেও শুনিনি। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে নির্বাচন জমে না। এই নির্বাচনের চেয়ে আমাদের ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচনই অনেক জমজমাট থাকে।