ভোটে নেই চিরায়ত চিত্র : কেন্দ্র থেকে নগরে ভূতুড়ে নিরবতা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ৯:৩১:০৩ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল: নির্বাচন মানেই ছিল এক উৎসবের আমেজ। দলে দলে পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ। এমনকি ভোট দিতে অনেকে দূর দারাজ থেকে নিজ এলাকায় চলে আসতেন। ফলে ভোট কেবল একটি নির্বাচনই নয় ছিল উৎবের আমেজে বিশাল এক মিলনমেলাও। কিন্তু রোববারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর লেশমাত্র দেখা যায়নি। জমজমাট বিভাগীয় শহর সিলেট ছিল অনেকটা ভূতুড়ে নগরের মতো। কেবল কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভোট কেন্দ্রের সামনে গুটি কয়েক নৌকার কর্মীদের টেবিল চেয়ার নিয়ে জটলাই ছিল একমাত্র লোকসমাগম। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ভোটারবিহীন ফাঁকা। অনেকে মজা করে একে নাম দিয়েছেন ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ ভোট উৎসব। মানে একেবারে দাগহীন ফকফকা ফাঁকা। যা ছিল চিরায়ত ভোট উৎসব বা নির্বাচনের একেবারে বিপরীত চিত্র।
অথচ এই কিছুদিন আগেও ভোটের দিন সেই সকাল ৮টা বাজার আগেই লাইনে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যেত। বিকেল তিনটার পর শুরু হতো হুড়োহুড়ি, কারণ চারটা বাজলেই ভোটপ্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ঠেলাধাক্কা, কার আগে কে ঢুকবে, সিল মারতে দেরি হলে বাইরে দাঁড়ানো ভোটারদের আওয়াজ ‘জলদি করো’ ‘জলদি করো’ চিৎকারে শুনে দৌড়ে আসতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লোকজনকে শান্ত করতে। কিন্তু এবার দুপুর গড়িয়ে গেলেও দেখা যায়নি ভোটারের লাইন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অল্প কয়েকজন যে সদস্য বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছিলেন তারা পার করছিলেন অলস সময়। উপস্থিত অনেকেই সরকার যতই বলুক এই ভোটে মানুষের সমর্থন আছে কিন্তু ভোটের মাঠের বাস্তব চিত্র তা বলছে না। যদি তাই হতো তাহলে এত মানুষ কোথায় গেল, আর লাইন একেবারে ফাঁকা কেন? তারা বলেছেন শুধু বিরোধীরাই যে এই ভোট বর্জন করেছে তা নয়, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে সরকার দলীয় সমর্থকদের বড়ো একটি অংশও ভোটপ্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নইলে ভোটের মাঠের চিত্র এমন হতো না। সরকার সমর্থক সবাইও যদি আসতো তাহলে লাইন হয়তো দীর্ঘ হতো না কিন্তু মানুষের সারি দেখা যেত। তারা বলেন নির্বাচনে কোনোবারেই শতভাগ ভোট কাস্ট হয়না। তারপরও লোকজনের ধাক্কাধাক্কি জনসমাগম লেগে থাকতো। কারণ শতভাগ ভোট এই সময়ে কাভার করা সম্ভব নয়। তাই গিত দিনে দেখা যেত যারা ভোট দিতে আসতেন তাদের মধ্যে অনেকেই শেষদিকে ভোট দিতে পারতেন না সময় শেষ হয়ে যাওয়ায়। এবার তাহলে বিপরীত চিত্র কেন ?
এদিকে অল্প যে কিছু লোকজন ভোট দিতে এসেছেন তাদের মধ্যে বড়ো একটা অংশ ছিল নতুন ভোটার, যারা শখ করে ভোট দিতে এসেছেন। কেউ কেউ বলেছেন ভোটের যে অবস্থা দেখছি তাতে আগামীতে আর ভোট হবে কিনা সেইটা প্রশ্ন তাই ভোট দিয়ে স্মৃতি রাখলাম।
সরেজমিন নগরীর দাড়িয়াপাড়ায় রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১টার দিকে দেখা যায় লাইনে কোনো ভোটার নেই। অল্প কয়েকজন পুলিশ সদস্য গাছের ছায়ায় বসে অলস সময় পার করছেন। গেইটের বাইরে নৌকার কর্মীরা সামিয়ানা টাঙিয়ে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছেন। ভোটার এলে স্লিপ দিয়ে ভোটকেন্দ্রে পাঠাবেন। এই কেন্দ্রে কথা হয় ভোটার জাকারিয়া মজুমদারের সাথে। তিনি বলেন ভোটার হবার পর কখনো ব্যালটে ভোট দিতে পারিনি। তাই স্মৃতি হিসেবে ভোট দিতে এসেছি।
দক্ষিণ সুরমার জালালপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর আড়াইটার দিকে দেখা যায় বিশাল মাঠ একেবারে ফাঁকা। লাইনে কোনো ভোটার নেই। স্থানীয়রা জানান এই কেন্দ্র একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তাই সবসময় এখানে ভোটারের চাপ থাকে। দুপুরের পর আমরা দেখে এসেছি লম্বা লাইনে ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু কী এক ভোট এলো ঠেলাঠেলি কী মানুষই নাই। এক দুজন যারা আসছেন তারা ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন, লাইনের কোনো দরকার পড়ছে না। একই চিত্র বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে দেখা যায় বিমানবন্দরের খাদিমনগর ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্র। ফলে একসময়ের জমজমাট ভোট কেন্দ্রে বিরাজ করছিল এক ভূতুড়ে সুনসান নিরবতা।
ভোট কেন্দ্রের সেই রেশ দেখা গেছে নগরেও। ভোট জমজমাট হলে জমে উঠে চায়ের স্টল। আগের স্টলগুলো ছাড়াও কেন্দ্রের আশপাশেও গড়ে উঠতে দেখা যেত অস্থায়ী চায়ের দোকান। কিন্তু এবার নতুন অস্থায়ী দোকান তো দূরের কথা পুরানো দোকানের অনেকগুলোই খুলেনি। খুলেনি দোকানপাট, রাস্তায় বের হননি লোকজন। বাইরে যে অল্প কিছু লোকজন দেখা গেছে তারা মূলত নৌকার কর্মী সমর্থক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক। এর বাইরে অল্প কিছু সাধারণ মানুষ বের হয়েছেন যারা ওষুধ কিনা, সিগারেট পান ইত্যাদি অতিব জরুরি কোনো প্রয়োজনে বের হতে বাধ্য হয়েছেন। সন্ধ্যার দিকে জিন্দাবাজার বন্দরবাজার সহ বহুল ব্যস্ত দু এক জায়গায় এক দুজন হকারকে দোকান খুলতে দেখা গেছে। তবে ছিল না কোনো ক্রেতা। ফলে দিনের ভোট কেন্দ্রের মতো সন্ধ্যার পর নগরীও অনেকটা ভূতুড়ে নগরে পরিণত হয়।