ভোটার হতাশায় ভোটগ্রহন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:২৮:৩২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বর্জন, সংঘাত, জাল ও ডামী ভোটের অভিযোগ আর ভোটার হতাশায় শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ।নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। রোববার বিকাল সাড়ে ৫টায় প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এই তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে শুরুতে সিইসি ভোটের হার ২৮ শতাংশের মতো উল্লেখ করে পরে তা সংশোধন করে বলেন এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। আরও হয়তো বাড়তে পারে। আবার নাও পারে!
এর আগে বিকাল ৩টার ব্রিফিংয়ে ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব। অর্থাৎ শেষ এক ঘন্টায় ভোট পড়েছে ১৩ শতাংশ!
যদিও সকালে নিজের ভোট দিয়ে নির্বাচন ভবনে ফিরে এসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে তিনি ভোটকেন্দ্রে নৌকার পোলিং এজেন্ট ছাড়া অন্য কারও এজেন্ট দেখতে পাননি।
ওদিকে, নির্বাচনের অনিয়মসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে ভোটের দিনে নির্বাচন বর্জন করেছেন ৪০ প্রার্থী। এর মাঝে সিলেটের ১২ প্রার্থী আছেন।
সিলেট-২ আসনে একসাথে অভিন্ন বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেন ৪ প্রার্থী। তারা হলেন- গণফোরামের মোকাব্বির খান, জাতীয় পার্টির এহিয়া চৌধুরী, তৃণমূল বিএনপি’র আব্দুর রব মল্লিক ও স্বতন্ত্র মুহিবুর রহমান। বেলা ২টায় ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজারে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন তারা। এসময় তারা নৌকার প্রার্থী শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম, কারচুপি ও জবরদখলের অভিযোগ করেন।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনের দুই প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। তাঁরা হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী আতিকুর রহমান। ভোট শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে তাঁরা পৃথকভাবে ভিডিও বার্তায় এ ঘোষণা দেন। এ আসনে নৌকার প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব।
সিলেট-৪ আসনে জালভোটসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন।
মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমান ও তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীকের প্রার্থী এম এম শাহীন। এ আসনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।
মৌলভীবাজার-৩ আসনে ২ প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ভোট কারচুপি, জালিয়াতি, কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়া, পেশিশক্তির প্রয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে এনে ভোট বর্জন করেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী এডভোকেট আবু বকর ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো: আলতাফুর রহমান।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে ভোট গ্রহণের পরিবেশ সকালে শান্ত থাকলেও বেলা তিনটার পর কিছু কিছু কেন্দ্রে অশান্ত হয়ে যায়। এসব কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জয়া সেন গুপ্তার (কাঁচি প্রতীক) পক্ষ থেকে নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনে প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়তায় জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ।
হতাশার ভোটার উপস্থিতি :
সিলেট নগর বা এর বাইরে ভোটের চিত্রে দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম। তার প্রমাণও মেলে সরেজমিন অনেক কেন্দ্র গিয়ে। বেলা ১১টায় সিলেট-১ আসনের অন্তর্গত নগরের পিটিআই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এখানে ভোট পড়েছে ৫৬টি, এই কেন্দ্রে ভোটার ৪ হাজার।
সরকারী আলীয়া মাদ্রাসা মহিলা কেন্দ্রে বেলা ১টায় গিয়ে দেখা যায়, ভোট পড়েছে মাত্র ৪৯টি! এখানে ভোটার ৩ হাজার ৩৭৬টি। দুপুর ২টায় পুলিশ লাইন স্কুলে গেলে জানানো হয়, ভোট পড়েছে ২ শতাংশ। এখানে ভোটার ১৯শ’।শাহজালাল জামেয়া মীরা বাজার সেন্টারে ৩৭১৫ ভোটের মধ্যে দিনশেষে ভোট পড়েছে ২৭০টি! ভোটের শতকরা হার ৭.২৬%।নগরের মির্জাজাঙ্গাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৭৭৩ জন। এর মধ্যে প্রথম ১ ঘণ্টায় ৮টি বুথে ভোট পড়েছে ৫৭টি।
বন্দর বাজার দূর্গাকুমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২ হাজার ৯৯৩ ভোট। সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মৃন্ময় দাশ জুটন জানান, প্রথম এক ঘণ্টায় ৪০টি ভোট পড়েছে।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচঙ-আজমিরীগঞ্জ) আসনের ১০টি কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে ভোটের হতাশাজনক চিত্র। বেলা ১২টায় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা সরকারি প্রাথমিক কেন্দ্রে ২০৮১ জন ভোটারের মধ্যে ১০৪ জন ভোট দিয়েছেন।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার যশকেশরী কেন্দ্রে সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪২ জন ভোট দিয়েছেন। ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২২৬১ জন। কেন্দ্রগুলোতে বিরাজ করে সুনশান নীরবতা।এদিকে, ভোটারদের সরব উপস্থিতি আর উৎসবমুখর পরিবেশ দেখাতে ভোটার নন, এমন ব্যক্তিদের এনে সিলেট নগরের একটি ভোটকেন্দ্রে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার ঘটনা ঘটেছে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দুর্গাকুমার পাঠশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দেড় শতাধিক নারী ভোটকেন্দ্রটিতে প্রবেশ করে কয়েকটি সারিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। তাঁদের অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল। প্রথমে সবাই তাঁদের ভোটার ভেবেছিলেন। পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, আসলে তাঁরা ভোটার নন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ওই নারীরা কেন্দ্রে অবস্থান করে চলে যান। তবে এসব নারীদের কাউকেই বুথের ভেতরে ঢুকে ভোট দিতে দেখা যায়নি।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত ১০ জন নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমে জানান, তাঁরা সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স। তবে তাঁরা কেউই এ কেন্দ্রের ভোটার নন। তবে একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দুজন নারী দাবি করেছেন, তাঁরা এ কেন্দ্রের ভোটার। দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ভোটার জানান, দুর্গাকুমার পাঠশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার সিলেট-১ (নগর ও সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি সকাল ১০টার দিকে ওই কেন্দ্রে ভোট দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভোট দেওয়ার সময় যেন কেন্দ্রটিতে ভোটারদের সরব উপস্থিতি দেখানো যায়, সে জন্য ভোটার নন, এমন ব্যক্তিদের এনে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বলে কেন্দ্রের ভেতরে গুঞ্জন ছিল।সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, যেসব নার্স হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করার কথা, তাঁরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। যাঁরা ছুটিতে আছেন, তাঁরা কী করছেন, সেটা তো জানা নেই। কারা ওই ভোট কেন্দ্রে গিয়েছেন, সেটা তাই জানা আমার পক্ষে অসম্ভব।
এদিকে দুর্গাকুমার পাঠশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মৃন্ময় দাশ ওরফে ঝুটন জানান, এখানে মোট ভোটার ২ হাজার ৯৯৩ জন। সকাল ৯টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রের ৭টি বুথে ভোট পড়েছে ৪০টি। প্রতিটি বুথে নৌকার এজেন্ট থাকলেও অন্য প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না।