সিলেটের বন্দরগুলোতে অচলাবস্থা, আন্দোলনে শ্রমিকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০:৪০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : পাথর-চুনাপাথর আমদানিতে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীদের চলমান ধর্মঘটে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে সিলেটের বন্দরগুলোতে। গত পাঁচদিন ধরে বন্ধ রয়েছে চুনাপাথর আমদানি।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) থেকে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরসহ ১৩টি শুল্ক স্টেশনে পাথর-চুনাপাথর আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানবেতর জীবনযাপন করছে পাথর আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শত শত শ্রমিক। তবে ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট কোনো সংকট সৃষ্টি করেনি বলে দাবি করছে শুল্ক বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে যে অ্যাসেসম্যান্ট ভ্যালু রয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে কম সিলেটে। আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অতিরিক্ত শুল্কায়ন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন পাথর-চুনাপাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। শনিবার (১৩ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে শত শত নারী-পুরুষ। পরে বিক্ষোভকারীরা ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকরক গ্রুপের অফিসের সামনে প্রতিবাদ সভা করে।
তামাবিল স্থলবন্দর শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাচ্চুর সভাপতিত্বে মানববন্ধনপূর্ব এক বিক্ষোভ মিছিল গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এদিকে শ্রমিক সংগঠন আহুত মানববন্ধনে সৃষ্ট যানযটের কারণে সিলেট তামাবিল মহাসড়কের দু’পাশের যানবাহন আটকা পড়ে ভোগান্তিতে পড়েন পর্যটক ও সাধারণ যাত্রীরা। পরে তামাবিল পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা আমদানীকারক গ্রুপের নেতৃবৃন্দের আশ্বাসে শ্রমিকরা দুই দিনের জন্য আন্দোলন থেকে সড়ে দাঁড়ান। তামাবিল স্থল বন্দর দিয়ে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখানকার কর্মরত সহস্রাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, গত ৮ জানুয়ারি থেকে সিলেট অঞ্চলের দুটি স্থলবন্দর ও ৫টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে পাথর ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভারত থেকে আমদানিকৃত পাথরের ওপর সরকারি অতিরিক্ত শুল্কায়ন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে তামাবিল স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে পাথর আমদানি বন্ধ করেন তারা।
ব্যবসায়ীরা জানান, ৪ মাসের মধ্যে ২ বার পাথর ও চুনাপাথর আমদানিতে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (আমদানি মূল্য) বাড়ানোতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা পাথর আমদানি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন- সারাদেশে যে অ্যাসেসম্যান্ট ভ্যালু আছে তার চাইতেও সর্বনিম্ন হার সিলেটে নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বর্ধিত ভ্যালু যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হবে না ততক্ষণ তারা পাথর ও চুনাপাথর আমদানি থেকে বিরত থাকবেন।
অন্যদিকে সিলেট শুল্ক বিভাগ বলছে, আমদানি বন্ধ হলেও কোনো সংকট দেখছেন না তারা। আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট সীমান্তের কাছে ভারতের পাথর-চুনাপাথরের খনি সমৃদ্ধ মেঘালয় রাজ্য। ফলে অন্য স্থানের তুলনায় কম পরিবহণ খরচ ও কিছুটা কম দামে মেঘালয় থেকে পাথর আমদানি করেন সিলেট অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। তামাবিল স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা গত ৮ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় পাথর আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে পাথরবোঝাই কোনো ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। কাজ না থাকায় বেকার বসে আছেন শ্রমিকরা। কোনো কোলাহল নেই। পাথরবাহী ট্রাক পারাপার না থাকায় অন্যরকম এক চিত্র দেখা মেলে। তবে শনিবার তামাবিল স্টেশন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন এর সাথে জড়িত শ্রমিকেরা।
শ্রমিক সংগঠন আহুত মানববন্ধনে সৃষ্ট যানযটের কারণে সিলেট তামাবিল মহাসড়কের দু’পাশের যানবাহন আটকা পড়ে ভোগান্তিতে পড়েন পর্যটক ও সাধারণ যাত্রীরা। পরে তামাবিল পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা আমদানীকারক গ্রুপের নেতৃবৃন্দের আশ্বাসে শ্রমিকরা দুই দিনের জন্য আন্দোলন থেকে সড়ে দাঁড়ান। তামাবিল স্থল বন্দর দিয়ে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখানকার কর্মরত সহস্রাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
শুল্ক বিভাগের তথ্যমতে, সিলেট অঞ্চলের দুটি স্থল বন্দর ও ৯টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার টন পাথর ও চুনাপাথর আমদানি হয়। গড়ে রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ৮৫ লাখ টাকা। আমদানি বন্ধ থাকায় প্রতিদিন সমপরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
তামাবিল চুনাপাথর, পাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সহ সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের অন্যান্য পোর্টের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের পোর্টের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু তুলনা করা হয় না। এর বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন ভারতের মেঘালয় লাগোয়া হওয়ায় পরিবহণ খরচ কম থাকে তবে পাথরের সঙ্গে ৪ ভাগের ১ ভাগ মাটি ও নিম্নমানের ব্যবহার অযোগ্য পাথর থাকে। তারপরও সামঞ্জস্য রাখার জন্য এতদিন শুল্ক বিভাগের অযৌক্তিক অ্যাসেসম্যান্ট ভ্যালুতেই শুল্ক দিয়ে এসেছি। বর্তমানে শুল্ক বিভাগ যা করছে তা সিলেট অঞ্চলের পাথর ব্যবসাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা।
তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে ৬ লেন ও বড় বড় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে। এসব কর্মকাণ্ডে যাতে সিলেটের ব্যবসায়ীরা পাথর সরবরাহ না করতে পারে সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই শুল্ক বিভাগ কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তাদের এই ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই সফল হবে না। ব্যবসায়ীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বর্ধিত অ্যসেসমেন্ট ভ্যালু প্রত্যাহার না করলে আমদানিতে ফিরবেনন না ব্যবসায়ীরা।
তামাবিল চুনাপাথর, পাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন বলেন, একটি সিমেন্ট কোম্পানি শিল্পের জন্য কাঁচামাল হিসাবে বেল্ট দিয়ে ভারত থেকে পাথর আনছে, সেই পাথর বাইরে বিক্রিও করছে। তাদের হয়েই কাজ করছে সিলেটের শুল্ক বিভাগ। স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে পাথর আমদানি বন্ধ হলে লাভ হবে সেই সিমেন্ট কোম্পানির। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলছেন সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট-এর সহকারী কমিশনার (অতিরিক্ত দায়িত্ব তামাবিল এলসি স্টেশন) মোঃ ফিরোজ হোসেন বিশ্বাস। শনিবার রাতে তিনি দৈনিক জালালাবাদকে জানান, সারাদেশে যে অ্যাসেসম্যান্ট ভ্যালু আছে তার সর্বনিম্ন তারা নির্ধারণ করেছেন। এটা আইন মেনেই করা হয়েছে। সিলেটের জন্য একবারে চাপিয়ে না দিয়ে দুই ধাপে গত আগস্টে ০.৭৫ ডলার আর এই জানুয়ারিতে ১.২৫ ডলার বাড়ানো হয়েছে। আমদানি বন্ধ থাকায় যে সংকট তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ কিভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোনো সংকট দেখছি না, আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, সবাইকে আইন মানতে হবে। আমদানী-রপ্তানির বন্ধের বিষয়টি উর্ধ্বতন মহল অবহিত রয়েছেন। তারাই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
এদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বর্ধিত ভ্যালু যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হবে না ততক্ষণ তারা পাথর ও চুনাপাথর আমদানি থেকে বিরত থাকবেন। অন্যদিকে সিলেট শুল্ক বিভাগ বলছে, আমদানি বন্ধ হলেও কোনো সংকট দেখছেন না তারা। আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাদের।
জানা গেছে, সিলেট সীমান্তের কাছে ভারতের পাথর-চুনাপাথরের খনি সমৃদ্ধ মেঘালয় রাজ্য। ফলে অন্য স্থানের তুলনায় কম পরিবহণ খরচ ও কিছুটা কম দামে মেঘালয় থেকে পাথর আমদানি করেন সিলেট অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি টন পাথর ও চুনাপাথর সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ ডলারে তারা আমদানি করেন। তবে এই পাথরের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ নিম্নমানের থাকায় তা ফেলে দিতে হয় তাদের। তবুও গত বছরের জুলাই পর্যন্ত শুল্ক বিভাগ আমদানি মূল্য নির্ধারণ করেছিল পাথর ১১ ডলার ও চুনাপাথর সাড়ে ১১ ডলার। যদিও এই হারে শুল্ক পরিশোধ করে তেমন লাভ থাকে না ব্যবসায়ীদের। এরই মধ্যে হঠাৎই গত বছরের আগাস্টে আবারও পাথর ও চুনাপাথরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ১ ডলার বাড়িয়ে পাথর ১২ ডলার ও চুনাপাথর সাড়ে ১২ ডলার করে চিঠি দেয় শুল্ক বিভাগ। সে সময়ও ক্ষুব্ধ হয়ে আমদানি বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। ৪ দিন বন্ধ থাকার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ৭৫ সেন্ট বৃদ্ধি নির্ধারণ করে নতুন অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু দাঁড়ায় পাথরের ক্ষেত্রে ১১.৭৫ ডলার আর চুনাপাথরের ক্ষেত্রে ১২.২৫ ডলার। এই হারে শুল্ক দিয়ে লাভ কম হলেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যখন হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, ঠিক তখনই ৪ জানুয়ারি আবারও অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ১.২৫ ডলার বৃদ্ধি করে পাথরের ক্ষেত্রে ১৩ ডলার আর চুনাপাথরের ক্ষেত্রে ১৩.৫০ ডলার নির্ধারণ করে চিঠি দেয় সিলেট শুল্ক বিভাগ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ৮ জানুয়ারি থেকে সিলেট বিভাগের দুটি স্থলবন্দর ও ৯টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে পাথর ও চুনাপাথর আমদানি বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা।