বাঁধের কাজ শুরুতে বিলম্ব: সুনামগঞ্জে বোরো ফসল রক্ষা নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ৮:০৭:০৮ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: ২০১৭ সালের প্রলয়ংকরী আগাম বন্যায় সুনামগঞ্জের বোরো ধানের স¤পূর্ণ ফলন নষ্ট হওয়ার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশোধন হয় কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা। সংশোধিত নীতিমালায় বলা হয়েছে বাঁধের কাজ ১৫ ডিসেম্বর শুরু করে আবশ্যিক ভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে বাঁধের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়াতো দূরের কথা সময় মতো তাহিরপুর উপজেলায় গঠন করা হয়নি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। যদিও আবশ্যিক ভাবে পিআইসি কমিটি অনুমোদন হওয়ার কথা ছিলো ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। তবে, তাহিরপুর উপজেলায় জানুয়ারি ১ম সাপ্তাহে ৮৮টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের পরপরই শুরু হয় পিআইসি কমিটি গঠনে নানান অনিয়মের অভিযোগ। অনুমোদন হওয়ার পর ২০ টি প্রকল্পের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে ৯ জানুয়ারি ২০ জন কৃষক স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ দায়ের করেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র কাছে। এছাড়াও ২নং শ্রীপুর (দঃ) ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন আরও ৩টি প্রকল্পের সভাপতি ও সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তবে অভিযোগ পাওয়ার পর তাতে নজর দেননি ইউএনও। পিআইসি কমিটি গঠনে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মতো কমিটি গঠনেরও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ আছে, গণশুনানি ছাড়াই মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ে টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন করারও। গেল সাপ্তাহে ‘তাহিরপুরে পিআইসি গঠনের অনিয়মের অভিযোগ, ক্ষুব্ধ কৃষকরা’ শীর্ষক শিরোনামে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রচার হলে তড়িঘড়ি করে কয়েকটি কমিটি বাতিল করেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা পারভীন। তবে, যেসব কমিটি বাতিল করা হয়েছে তাদের আত্মীয় কিংবা পছন্দের মানুষের নামেই আবার কমিটি অনুমোদন। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। এদিকে নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার ১ মাস পেরিয়ে গেলেও তাহিরপুর উপজেলায় শুরু হয়নি সবকটি বাঁধের কাজ। যদিও দায়িত্বশীলরা বলছেন বেশিরভাগ প্রকল্পে কাজ চলমান রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ (ক্লোজার) ১৬ টি বাঁধের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র ৫টিতে। তবে, সময়মতো বাঁধের কাজ শুরু না হওয়ায় উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। অভিযোগ আছে, হাওরের প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাঁধের কাজ। ফলে কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শুধু মহালিয়া হাওর নয় উপজেলার শনি ও মাতিয়ান হাওরেও বেশ কয়েকটি পিআইসি কমিটি তুলে দেওয়া হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকের হাতে। এমনকি কৃষক নন এমন একই পরিবারের ২-৩ ভাই পিআইসির সভাপতি কিংবা সদস্য সচিব বনেছেন। তবে অযোগ্যদের পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব এর দায়িত্ব দেওয়ায় ফুঁসে উঠছেন হাওরের কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, অনুমোদন হওয়া কমিটি বাতিল করে পূনরায় নতুন করে প্রকৃত কৃষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করার কথা। পাঠাবুকা গ্রামের বাসিন্দা ও দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া বলেন, যাদের কাজ করার সামর্থ ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই তাদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিয়নে আমার ওয়ার্ডেই পিআইসি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কাজ দেওয়া হয়েছে অনেক অযোগ্যকে। যাদের যোগ্যতা আছে তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মাটিয়ান হাওরের পারের কৃষক ও পরিবেশ কর্মী আব্দুল আমিন বলেন, প্রতি বছর নিতিমালা অনুযায়ী গনশুনানীর মাধ্যমে পিআইসি কমিটি গঠন করা হয়। এই বছর গনশুনানী করার পর এসও এক দালালের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষককে বাদ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের সুপারিশে কয়েকটা কমিটি দিয়ে বাকি প্রায় সব কটি কমিটি প্রতিটি এক লক্ষ করে টাকার বিনিময়ে দিয়েছে, যাহা নিতীমালা বহির্ভূত। আমরা প্রকৃত কৃষক যারা আছি তারা এই অনিয়মের তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাই। প্রতি বছর যারা সফলতার সাথে পি আই সি কমিটির কাজ করে তাদেরকেও বাতিল করা হয়েছে। আমরা হাওরবাসী এই অনিয়মতান্ত্রীক প্রকাশিত কমিটি বাতিলের দাবি জানাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহালিয়া হাওরের কয়েকজন কৃষক বলেন, প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে এই হাওরে পিআইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও মৎস্য ব্যাবসায়ীকে। তাছাড়া তার কোনো জমিও নেই। কিভাবে সে পিআইসি কমিটি পেল তা এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। হাওর বাঁচাও তাহিরপুর উপজেলা যুগ্ম আহ্বায়ক তুজাম্মেল হক নাছরুম বলেন, যদি কোনো পিআইসি নিয়ে বিতর্ক কিংবা অভিযোগ ওঠে, তাহলে এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে আমি মনে করি। প্রকৃত কৃষকরা যদি বাদের কাজ পায় তাহলে হাওরের ভালো কাজ হবে। এবিষয়ে তাহিরপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা পারভীন কোনো কথা বলতে রাজি নন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের বন্যশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের জন্য পাঁচ থেকে যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কাজের আর্থিক মূল্যের হিসাবে প্রতি ২৫ লাখ টাকার একটি করে স্কিম প্রস্তুত করে তার জন্য বাঁধের পার্শ্ববর্তী কৃষি জমির মালিকদের নিয়ে একটি করে পিআইসি গঠন করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের আগে জরিপ শেষ করে সব পিআইসি গঠন করতে হবে। তারপর ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করার কথা উল্লেখ রয়েছে।