ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের চাপে সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ৮:৫৮:১২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বাংলাদেশ সরকারের সামনে ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৪৯ ভাগ। ঐ ছয় মাসে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল হিসেবে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) একই সময়ে যা ছিল ১০৫ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) মোট আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হবে ৩২৮ কোটি ডলার। আগামী অর্থ বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে ৪০০ কোটি ডলার। এরপর এর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। ২০২৯-৩০ সালে যা হবে ৫১৫ কোটি ডলার। ঠিক এখন সরকারের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭৬ কোটি মার্কিন ডলার।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনের সুদের হার (সিকিউর্ড ওভারনাইট ফাইনান্সিং রেট-এসওএফআর) বেড়ে গেছে। এখন এই রেট পাঁচভাগের বেশি হলেও ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ছিল এক ভাগ। আর বাংলাদেশের বাজারভিত্তিক (শর্ট টার্ম) ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে সুদ বেশি গুণতে হচ্ছে আর সময়ও কম পাওয়া যাচ্ছে। আর বেশকিছু মেগা প্রকল্প, যেমন- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশী ঋণের ‘গ্রেস পিরিয়ড’ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য যে ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর যদি আমাদের রফতানি খাতে অবদান রাখতে পারে, যদি আমরা আরো বেশি পরিমাণ রফতানি করতে পারি, বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারি, তাহলে ঋণের চাপ কমবে। আমাদের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদেশী মুদ্রায়। তাই আমাদের রফতানি আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে। এর সাথে প্রকল্প ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। এখন যা শুনছি সরকার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার কথা বলছে। নতুন কোনো প্রকল্প তার আগে না নেয়ার কথা বলছে। তাতে মনে হচ্ছে, সরকারের একটা রিয়েলাইজেশন হয়েছে। তবে এরই মধ্যে যে ঋণ নেয়া হয়েছে, যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেই প্রকল্পগুলোও রিভিউ করা দরকার। কত দিন লাগবে বাস্তবায়ন করতে। কতটা ভায়েবল হবে।’
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তারপরেও দেশে যে উন্নয়নমূলক কর্মকা- চলছে, তাতে আমাদের ঋণ লাগবে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আমরা কোনো ধরনের ঋণ নেব। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এইসব বহুপক্ষীয় সোর্সগুলোতে ঋণের সুদ কম এবং গ্রেস পিরিড বেশি থাকে। কিন্তু দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে যে ঋণ নেয়া হয়, তার সুদের হার বেশি থাকে এবং সেগুলো শর্ট টার্ম হয়ে থাকে। গত ১০ বছরে আমরা এই শর্ট টার্ম ঋণ বেশি নিয়েছি। ফলে তা শোধ করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিলে তাদের অনেক শর্ত থাকে। সেটা এড়িয়ে যেতেই হয়তো বা সরকার শর্ট টার্ম ও বেশি সুদে ঋণের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু এই ঋণ আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দুই দিক থেকে বিদেশী ঋণের চাপ বাড়ছে। একটা হলো, ডলারের দাম বাড়ছে, যা আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে। আর হলো, ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ডেফিসিট। আমরা যে ঋণ ইদানিংকালে নিয়েছি, সেগুলোর ব্যবহার যথাসময়ে করতে না পারায় ওই ঋণ থেকে রিটার্ন আসছে না। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়ার সময় চলে এসেছে। ফলে আয় নেই, কিন্তু দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তার কথা, ‘যে ঋণ আমরা নিয়েছি, সেটা তো আমাদের ফেরত দিতে হবে। ফেরত না দেয়ার তো কোনো বিকল্প নেই। এখন এই ঋণ পরিশোধ করতে হলে আমাদের রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। আর কোনো পথ দেখছি না। আমাদের ডলার আয় বাড়াতে হবে। নয়তো ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অন্যখাতে না আবার ডলার সঙ্কট তৈরি করে। আর নতুন ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যেসব ঋণ সস্তায় পাওয়া যায়, দীর্ঘ মেয়াদে পাওয়া যায়, সেটা নিলে আমাদের চাপ বাড়বে না। যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবির ঋণ ৩০ বছর মেয়াদে। দুই থেকে আড়াই শতাংশ সুদ। আরো পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়। তবে তাদের তো আবার পছন্দের প্রকল্প আছে। সেটা ধরে আমাদের জন্য যেগুলো ভায়াবল হবে, সেগুলো আমরা নিতে পারি। আর চীনসহ যেকেনো দ্বি-পক্ষীয় ঋণেরই সুদের হারই বেশি। সময় কম। আবার তাদের শর্তও বেশি। তাই ওই ধরনের ঋণ নিলে হিসাব করে নিতে হবে, যাতে প্রকল্প থেকেই ঋণ শোধ করা যায়। পেলেই নিতে হবে, সেটা নয়। লাভজনক হলে নেয়া যাবে।
এ বিষয়ে সদ্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমরা ঋণ করেছি, তা তো শোধ করতে হবে। ঋণের চাপ তো বাড়বেই। গত ছয় মাস, নয় মাস নির্বাচনের কারণে, রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতি চাপে ছিল। রাজস্ব আদায়, বিনিয়োগসহ আরো অনেক দিকে সমস্যা হয়েছে। আমার মনে হয় এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। যদি ছয় মাসও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে, তাহলে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
তার কথা, ‘প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, নতুন প্রকল্পে না গিয়ে, কৃচ্ছতা সাধন করে, যে প্রকল্প আছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা মনে হয় ভয়ঙ্কর কিছু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অর্থনীতিতে একটা মেসেজ যাবে। পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যাবে।’ সূত্র : ডয়চে ভেলে