ফের ভাঙনের পথে জাতীয় পার্টি
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৮:১৮:১৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দেওয়ার একদিন পর বুধবার নতুন নেতৃত্ব সম্পর্কে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন রওশনপন্থিরা। রওশনের নিয়োগ করা মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদের সই করা চিঠি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে নবনিযুক্ত দলের মুখপাত্র ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়ের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল সিইসির একান্ত সচিবের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চিঠি হস্তান্তর করেন। যদিও ইসি থেকে বলা হচ্ছে, চিঠি আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই। জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এই সিদ্ধান্তকে ভিত্তিহীন বলে বিক্ষোভকারীদের কোনো দিন ক্ষমা না করার কথা সাফ জানিয়ে দেন। অর্থাৎ জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি রওশনপন্থিদের কোনো কিছুকেই আমলে নিচ্ছে না। ফলে জাপা ফের ভেঙে রওশনপন্থিদের দ্বারা আরও একটি দল গঠন হতে যাচ্ছে কিনা- এই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলটি গঠনের পর থেকেই নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করেছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতনের পর এই নাটকীয়তা আরও বাড়তে থাকে। দলটি নানা ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনায় থেকেছে। জন্ম দিয়েছে একের পর এক ‘হাস্যকর’ ঘটনার। এক দল ভেঙে ধাপে ধাপে অনেকগুলো দল সৃষ্টি হয়েছে। এবার আরেক দফা ভাঙনের দিকে যাচ্ছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
এর আগে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি ভেঙে ছয়টি দলের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এগুলো হচ্ছেÑ জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, ডা. মতিনের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, মোস্তফা জামান হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও সর্বশেষ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (পুনর্গঠন)। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের), জেপি (মঞ্জু), বিজেপি (পার্থ), জাতীয় পার্টি (ডা. মতিন) এই চার দলের নিবন্ধন রয়েছে। জেপি (মঞ্জু) বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা আন্দালিব রহমান পার্থর বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জু। বিজেপি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকলেও পরে বের হয়ে যায়।
বুধবার ইসিতে পাঠানো রওশনপন্থিদের চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৮ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং একাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের গুলশানস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের এক জরুরি বর্ধিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। চেয়ারম্যান তার ক্ষমতা বলে কাজী মো. মামুনুর রশিদকে জাতীয় পার্টির অন্তর্বর্তীকালীন (পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া অবধি) মহাসচিব নিয়োগ করেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ এবং মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ জাতীয় পার্টির দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচলনা করবেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান হয় ওই চিঠিতে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও তাহাদের ক্ষমতার বিন্যাস: গঠনতন্ত্রের ধারা-২০ এর (উপধারা-১): জাতীয় পার্টিতে একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকিবেন। তিনি পার্টির সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হইবেন। পার্টির কোনো জনসভায় তিনি উপস্থিত থাকিলে চেয়ারম্যানের ওপরে তাহার স্থান হইবে। জাতীয় ও দলীয় সকল বিষয়ে চেয়ারম্যান তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিবেন। তিনি দলের পতাকা বহন ও সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করিবেন।
এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ গণমাধ্যমকে জানান, জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে ও মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান পদে আসীন করার যে ঘোষণা রওশন এরশাদ দিয়েছেন, সেটি আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই নির্বাচন কমিশনের। তবে দল ভেঙে গেলে বা কাউন্সিলের পর নতুন কমিটির কোনো চিঠি এলে তা আমলে নেওয়া হবে।
সম্প্রতি গণতন্ত্রী পার্টি এমন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ইসির নিবন্ধন হারানোর পথে রয়েছে। জাতীয় পার্টিরও সে অবস্থা হতে পারে কিনাÑ এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব বলেন, পরিস্থিতি একই হলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইসিতে যাওয়া রওশনপন্থিদের মধ্যে ছিলেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, সাবেক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ও নতুনবাংলা ছাত্র সমাজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রফিকুল হক হাফিজ, পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু, জাতীয় ছাত্রসমাজের সাবেক সভাপতি খন্দকার মনিরুজ্জামান টিটু, সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মামুনুর রশীদ, ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, খোরশেদ আলম খশু, পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম শাহজাদা, এসএম হাসেম, এমএ রহিম খান, শেখ রুনা, সেরাজুল আরেফিন মাসুম ও জাতীয় ছাত্রসমাজের সদস্যসচিব আবু সাঈদ লিয়ন।
গত রোববার গুলশানে নিজের বাসায় দলের ‘ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত’ নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা করে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ নিজেকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি নতুন পদে নিয়োগদান করেন। ওইদিনই জিএম কাদেরকে দ্বাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সংসদ সচিবালয়।
জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি নেতাদের ভাষ্য, আগামী ২ মার্চ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের মাধ্যমে দলে নতুন নেতৃত্ব আসবে।
অন্যদিকে সোমবার সকালে বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘সংসদে দলীয়ভাবে আমরাই একমাত্র বিরোধী দল। স্পিকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে জাপা চেয়ারম্যানকে যে স্বীকৃতি দিয়েছেন তা যথার্থ হয়েছে। সংসদে আমরা যে বিরোধী দল সেটা স্পিকারের দৃষ্টিতে এসেছে। সংসদের কার্যক্রমে এটা উল্লেখ থাকবে। সংখ্যাটা বড় নয়, সংসদে কারা বিরোধী সেইটা মেইন জিনিস।’
তিনি বলেন, “এ দেশের মানুষ যা চায়, তাদের যে দাবি, সেটা প্রমাণ করার একটা সুযোগ এসেছে এইবার। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সমালোচনা ছিল আমরা ‘গৃহপালিত’, এই শব্দগুলো যাতে আর ব্যবহার না হয় সেজন্য সংসদে এবং সংসদের বাইরে আমাদের ভূমিকা আমরা রাখব।”
রওশন এরশাদের ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রবিবার যে কাজটা করেছে, তারা কেউই দলের কোনো পদে নেই, সামান্য মেম্বারও না। শুধুমাত্র বেগম এরশাদ, তিনি আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। উনি খুবই অসুস্থ। স্বাভাবিক রাজনীতির কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ওনার নেই। ওনাকে কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করছে।’
চুন্নু বলেন, ‘যারা এসব কাজ করছে তারা কোনো দিন ক্ষমা চাইলেও দল তাদের ক্ষমা করবে না। আমি মহাসচিব হিসেবে এটা মনে করি। তারা দলের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য এটা করেছিল। আজ থেকে সেই বিভ্রান্তি আর থাকবে না।’