ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২:০০:২৫ অপরাহ্ন
হাওর বাঁচাও বলছে, কাজ হয়েছে ২০%, পাউবো’র দাবী ৪৫%
এমজেএইচ জামিল : প্রতি বছরের মতো এবারও সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের অগ্রগতি কম থাকায় দুশ্চিন্তায় কৃষক। পাউবোর পক্ষ থেকে ৪৫ শতাংশ কাজ হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে হাওর বাঁচাও আন্দোলন বলেছে, কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। ফলে যথাসময়ে অর্ধেক কাজ শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
কর্তৃপক্ষের দাবি, নির্বাচনের কারণে পিআইসি গঠন বিলম্বিত হয়েছে। এ ছাড়াও একটি পক্ষ চায়নি নির্বাচনের আগে কাজ শুরু হোক। তারা বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করেছে। পিআইসি গঠনের পর ফের নানান অভিযোগ তোলা হয়। এসব কারণে কাজ যথাসময়ে শুরু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন পাউবো প্রকৌশলী ও দায়িত্বশীলরা। তবে এখন বাঁধ নির্মাণের কাজ দ্রুত চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় কৃষকদের দাবি, বাঁধ নির্মাণকাজ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কাজ শুরু না হওয়ায় শঙ্কিত তারা। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ হলে পানির প্রথম ধাক্কায় বাঁধ ভেঙে যায়।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দেড় মাস পার হলেও সুনামগঞ্জের ৩৮টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ এখনো ২০ শতাংশও সম্পন্ন হয়নি। ঝুঁঁকিপূর্ণ ১৫৯টি ক্লোজারও (বাঁধের ফাঁকা স্থানের গভীর গর্ত) অরক্ষিত। বিলম্বে কাজ শুরু হওয়ায় বাঁধ টেকসই হবে না এবং বাঁধের গোড়া থেকে মাটি কাটায় আগাম বন্যায় ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষক ও হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা।
সুনামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ জেলার অধিকাংশ মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে হাওরের বোরো ধানের ওপর। ২০১৭ সাল থেকে হাওরের ফসল রক্ষায় ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে কৃষকদের অংশগ্রহণে পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের মাধ্যমে বাঁধের কাজ করার কথা থাকলেও পিআইসিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছেন কৃষকরা। সম্প্রতি এই অভিযোগে একাধিক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ বোরো মৌসুমে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার ৩৮টি হাওরের বাঁধের প্রাক্কলন শেষ হয় গত বছরের নভেম্বরে। পাউবোর সার্ভেয়ারদের জরিপের ভিত্তিতে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চূড়ান্ত করে ৭৩৪টি পিআইসি গঠিত হয়।গত ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা থাকলেও শুরু হয় নির্বাচনের পর। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু কাজের ধীরগতিতে কৃষকরা উদ্বিগ্ন। এভাবে চলতে থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হবে কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
কৃষকরা জানান, পিআইসি নীতিমালা অনুযায়ী জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্যসচিব পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। উপজেলা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্যসচিব পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপজেলা সেকশন অফিসার।উপজেলা থেকে হাওরের গ্রামগুলোতে গিয়ে গণশুনানি করে বাঁধ এলাকার জমির মালিক ও সুবিধাভোগী কৃষকদের নিয়ে পিআইসি গঠন করার কথা থাকলেও সেটা না করে গোপনে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা থেকেই কমিটি অনুমোদনের নামে ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ক্ষোভ জানিয়েছেন কৃষকরা। এ ছাড়া অক্ষত বাঁধেও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের অর্থ অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, আগাম বন্যা প্রথম বাঁধের ক্লোজারে আঘাত হানে। ক্লোজারের নিচে গভীর গর্ত থাকায় নদী বা খাল পানিতে উপচে উঠলে বাঁধ ধসে যায়। তাই এসব ক্লোজারে শুরুতেই বাঁধ দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু ১৫৯টি ক্লোজারের মধ্যে এখনো অর্ধেকের কাজ শুরু হয়নি।তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, ১৫৬টি ক্লোজারে সম্প্রতি কাজ শুরু হয়েছে এবং কাজের গড় অগ্রগতি ৪২ শতাংশ।
দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের অমর চান দাস বলেন, বিলম্বে কাজ শুরু হওয়ায় বৃষ্টি ও আগাম বন্যার ধকল সইতে পারবে না বাঁধ। এতে ফসলহানির ঘটনা ঘটবে।শান্তিগঞ্জ উপজেলার হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ডা. নজরুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমি গত কয়েকদিনে উপজেলার ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫নং পিআইসি সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি। কোথাও ২০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে আবার কোথাও কাজ শুরুই হয়নি। এভাবে কাজ চলতে থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে অর্ধেক কাজও শেষ করা সম্ভব নয়।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনন্তপুরের হাওর আন্দোলনের নেতা শফিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাওরে কাজ শুরু হয়নি। বাইরের এলাকার কৃষকদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে। ফলে হাওর অরক্ষিত থাকবে, কেননা জরুরি অবস্থায় বাঁধ রক্ষায় তারা সময়মতো আসতে পারবে না।’
ছাতক উপজেলার বড়কাপন গ্রামের দেখার হাওরের কৃষক হরমুজ আলী বলেন, যেখানে মেরামতের দরকার নেই, ঘুষের বিনিময়ে সেখানেও অনেক টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে। কাজের গতিও অনেক কম। এভাবে কাজ চললে ৩ মাসেও কাজ শেষ হবে বলে মনে হয়না।
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এবারের পরিস্থিতি অতীতের চাইতে আরো ভয়াবহ। কারণ এখনো বিপদজনক ক্লোজারগুলোর কাজই শেষ হয়নি। বাঁধ নির্মাণ করবে কখন। আমরা কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখেছি, এখনো ২০ শতাংশ কাজ হয়নি। আমরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে দুর্নীতি ও অনিয়ম থামানোর দাবি জানিয়ে আসছি। দুয়েক দিনের মধ্যে প্রেস কনফারেন্স করে মাঠে নামতে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, প্রতি বছরই পাউবো ও প্রশাসনের একটি দুর্নীতিবাজচক্র স্থানীয়দের পাশ কাটিয়ে পিআইসি গঠনের নামে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রকল্প দেয়। এবারও তাই হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। এভাবে মন্থরগতিতে কাজ চলতে থাকলে নির্ধারিত সময়ে অর্ধেক কাজও হবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে।
পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ইতোমধ্যে ৪৫ শতাংশ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ক্লোজারের কাজ ৭০ শতাংশের উপরে শেষ হয়েছে। কিছু জায়গায় পানি দেরিতে নামার কারণে মাটির অভাবে বাঁধের কাজ সময়মতো শুরু করা যায়নি। তবে এখন সব প্রকল্পেই দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। আশা করি, যথাসময়ে কাজ শেষ হবে। কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা কিসের ভিত্তিতে ২০ শতাংশ কাজ হয়েছে বলেছেন তা আমার জানা নাই। উনারা যদি নির্ধারিত করে জায়গার নাম বলে দিতে পারেন তাহলে আমরা চিহ্নিত করতে পারবো। কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
জেলা প্রশাসক ও বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, প্রতিটি উপজেলাতেই কাজ শুরু হয়েছে। পাউবো কর্তৃপক্ষসহ আমরা নিয়মিত মনিটর করছি। বাঁধের কাজ যাতে যথাযথভাবে ও যথাসময়ে সম্পন্ন হয় সেদিকে নজরদারি রয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশের উপরে বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। যথাসময়ে কাজ শেষ করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে জানিয়েছেন, এবছর সুনামগঞ্জের প্রায় ৪ লাখ কৃষক পরিবার ২ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন। এসব জমি থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে। যার বাজার মূল্য ৪ হাজার ১২০ কোটি টাকা।