অস্থির বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৯:২২:৫৩ অপরাহ্ন
*মর্টার শেলে বাংলাদেশীসহ নিহত ২ * মায়ানমারের ৯৫ সীমান্তরক্ষীর বাংলাদেশে আশ্রয় * অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ৪০০ চাকমা
জালালাবাদ রিপোর্ট : সাত ঘণ্টা বিরতির পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে আবারও গোলাগুলি হয়েছে। উপর্যপুরী মর্টার শেলে প্রকম্পিত হয়েছে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত। মর্টার শেলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশীসহ ২ জনের। গতকাল পর্যন্ত মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৯৫ জন সদস্য অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন।
মর্টার শেলে নিহতদের একজন বাংলাদেশি নারী এবং অপরজন ঐ বাড়িতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করা রোহিঙ্গা পুরুষ। তারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দা।নিহত নারী জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৫৫)। নিহত রোহিঙ্গার নাম নবী হোসেন (৬৫)। তিনি বালুখালী আশ্রয়শিবিরের ৮-ই ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি হোসেনে আরার বাড়িতে ধানখেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন।
সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মর্টার শেলটি এসে পড়ে।ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ ঘটনাস্থল থেকে এই দুজনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বেলা পৌনে তিনটার দিকে রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে দুপুরের খাবার দেওয়ার জন্য রান্নাঘরে যান হোসনে আরা। তখন মর্টার শেলটি এসে রান্নাঘরের ওপর পড়ে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান বলেন, দুপক্ষের গোলাগুলির সময় মর্টার শেল এসে বিস্ফোরিত হয়েছে। তখন ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়েছেন। তবে হেলিকপ্টার থেকে বোমা মারার সময় গোলাটি এসে পড়েনি বলে মন্তব্য করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান বিবিসিকে বলেন, এতদিন মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যে গুলি ও বোমার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল গত দুই তিন দিনে এটি বেড়েছে। মানুষের বাড়িঘড়ের ছাদের ওপরে গুলি, মর্টার শেলের খোসা পড়ছে। আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছাড়ছে এলাকাবাসী। এতে জনশূণ্য হচ্ছে আশপাশের গ্রাম।
ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়ার কাছাকাছি মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি ঘিরে রোববার রাত ১১টায় গোলাগুলি শুরু হয়। সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ চলে।স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের লোকালয়ের একদম কাছাকাছি। ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও বাংলাদেশের লোকালয়ের মাঝখানে নাফ নদী ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় মানুষের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোববার রাত ১১টার দিকে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি ঘিরে গোলাগুলি শুরু হয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত একটানা গোলাগুলি চলে। এতে উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আনজুমানপাড়া, বালুখালী ও দক্ষিণ বালুখালী গ্রামের মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি করেছেন। এসব এলাকার মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা বলেন, বাইশফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় ও মিশকাতুন্নবী দাখিল মাদ্রাসা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জেলা প্রশাসক, ইউএনওর সঙ্গে আলোচনা করে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা হবে।
এদিকে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন দেশটির চাকমা সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ জন। পাশাপাশি কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাও সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন। তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান।
মো. মিজানুর রহমান বলেন, মিয়ানমারে দেশটির সরকারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সংঘর্ষ চলছে। এতে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই অবস্থায় তাঁরা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার থেকে কোনো রোহিঙ্গা অথবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সে জন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।