ওপারে ভয়ঙ্কর গোলাগুলি, এপারে নির্ঘুম রাত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৮:০৬:৪৮ অপরাহ্ন
*আতঙ্কে সীমান্তবর্তী ১৩ গ্রাম জনশূণ্য * বিজিপি-সেনাসহ ২৬৪ জন পালিয়ে বাংলাদেশে * রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাংলাদেশের কড়া প্রতিবাদ
জালালাবাদ রিপোর্ট: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি ঘিরে রাতভর গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেঁপে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অন্তত ১৩টি গ্রাম। সোমবার রাত ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত অনবরত গোলাগুলির শব্দে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে এপারের বাসিন্দারা।
মঙ্গলবার ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে কয়েকজন পুরুষ ছাড়া কেউ নেই। নারী-শিশুরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্রে অবস্থান নিয়েছে। ঘরের বাইরে খুব কম মানুষকে দেখা গেছে। মধ্যমপাড়া পাঞ্জেগানা মসজিদে নিয়মিত আজান দেন আবদুস সোবহান (৭০)। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার ভোরে ফজরের আজান হয়। কিন্তু একজন মানুষও নামাজে আসেননি। সবার মধ্যে গোলাবারুদের ভয় কাজ করছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ১৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)–এর সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা আছেন। এ নিয়ে গত রোববার থেকে দেশটির মোট ২৬৪ জন পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যাদের বেশির ভাগ বিজিপির সদস্য।বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশটির ২৬৪ বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাসদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি। এই চৌকির দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে রোববার রাত ১১টা থেকে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে একটি মর্টার শেল ঘুমধুমের জলপাইতলী গ্রামে এসে পড়লে দুজন নিহত হন। এরপর আতঙ্ক বেড়ে যায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। গতকালও মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সৈয়দ আলম (৩৮) নামের আরও এক বাংলাদেশি যুবক আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পশ্চিমকুল পাহাড়পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে দুইজনের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আসেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত। পরে ১১টা ৩৫মিনিটের দিকে বের হয়ে যান তিনি।
স্থানীয় লোকজন বলেন, ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলকে ঘিরে রোববার রাত থেকে থেমে থেমে আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ চলছে। গতকাল সোমবার দুপুরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে অন্তত পৌনে এক ঘণ্টা গোলাবর্ষণ করে। কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে রাত নয়টা থেকে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার থেকে গোলা ফেলা হয়, মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে আজ মঙ্গলবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত চলে। সংঘর্ষের গোলাবারুদ এসে পড়ছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। এতে এপারে ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, ম-লপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, বেতবুনিয়া বাজার পাড়া, পাশের পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমান পাড়া, বালুখালী, দক্ষিণ বালু খালী এলাকা প্রকম্পিত হয়।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সোমবার রাত নয়টা থেকে দুই পক্ষের লড়াইয়ের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। এত কম্পন আমরা আর দেখিনি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকাজুড়ে কেঁপে ওঠে। একটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছেন লোকজন।’ স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাতে সংঘর্ষ চলাকালে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত ছয় সদস্যকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখা গেছে। তাঁদের বালুখালী বিজিবি ক্যাম্প ও ঘুমধুম বিজবি ক্যাম্পে হেফাজতে রাখা হয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রাতে নির্ঘুম রাত পার করেছে মানুষ। মর্টার শেলে দুজন নিহত হওয়ার পর আতঙ্ক দ্বিগুণ বেড়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনে কাউকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, মিয়ানমারে যুদ্ধের জেরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা এবং আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান এবং বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। মিয়ানমারেরও প্রতিবেশী দেশ ভারত। দিল্লি সফরে ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হবে। যেহেতু বর্তমানে মিয়ানমার ইস্যু এসেছে, তাই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনাটা স্বাভাবিক।