জোট সরকারের পথে পাকিস্তান
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৯:৩৩:১৬ অপরাহ্ন
* সরকার গঠনে তৎপর পিটিআই *নেওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী মানতে নারাজ পিপিপি
জালালাবাদ রিপোর্ট : পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করতে পারেনি দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। তবে পাকিস্তানের একাধিক গণমাধ্যমের খবরে শুক্রবার রাত পর্যন্ত ২৪৫টি আসনের ফলাফল জানা গেছে। সেখানে দেখা গেছে, ৯৮টি আসনে জয়ী হয়েছেন ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, ৬৯টি আসন পেয়েছে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৫১টি আসন।
এতে দেখা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন তাদের জোট গঠন করতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তানে জোট সরকার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। তবে কোন দলের নেতৃত্ব জোট গঠিত হবে— এবং নির্বাচনে সর্বোচ্চ আসন পাওয়া পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে জোট গঠন করা হবে কি না সেটি এখন দেখার বিষয়।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাইঘাম খান কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, যে চিত্রটি দেখা যেতে পারে সেটি হলো একটি জোট সরকার। যেই জোটে পিটিআই ছাড়া বাকি রাজনৈতিক দলগুলো থাকবে। এতে থাকবে দেশটির দুই বড় দল পিপিপি এবং পিমএএলএন। সঙ্গে থাকবে এমকিউএম, জামাত-ই-ইসলামী ও অন্যান্যরা।দ্বিতীয় চিত্র, যেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম কিন্তু হতে পারে, সেটি হলো পিটিআইয়ের সঙ্গে পিপিপি যোগ দেবে এবং সরকার গঠন করবে।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও জানিয়েছেন, পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ পরবর্তী সরকারের বৈধতাকে বিশ্বাস করেন না ভোট কারচুপির অভিযোগের কারণে। আর এ বিষয়টি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলবে।তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পাকিস্তানে কয়েকদিনের জন্য থাকবে না।
আলজাজিরার পাকিস্তান প্রতিনিধি, সাংবাদিক কামাল হায়দার বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বার্তা হলো- তিনি চান পিপিপি তাদের সঙ্গে যোগ দিক এবং জোট সরকার গঠন করুক। যেমনটি তারা করেছিল ২০২২ সালের এপ্রিলে। ওই জোট গঠনের মাধ্যমে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারা।
কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে কী হবে- এ মুহূর্তে তা বলা কঠিন। পিটিআই কিছু জায়গায় ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে এবং সেসব আসনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করেছে। যদি আদালত এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে পিটিআইয়ের পক্ষে রায় দেন তাহলে নওয়াজের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। তার সঙ্গে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন- সেটি নিয়ে নওয়াজ শরীফের পিমএমএলএন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপির মধ্যে পার্থক্য দেখা যাবে। যদিও নওয়াজ একটি জোট গঠনের চেষ্টা চালাবেন। তবে বিষয়টি তার জন্য সহজ হবে না।
এদিকে দেশটির কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৬৫ আসনের মধ্যে ১৭০টিতে জয় পেয়েছে বলে দাবি করেছে। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে পিটিআই সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে বলে শনিবার দলটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গোহর খান ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল শনিবার মাঝরাতের মধ্যে প্রকাশ করা না হলে রোববার পিটিআই দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডনের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় পরিষদের ২৬৫টি আসনের মধ্যে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯২টি আসনে জয় পেয়েছেন। আর নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭১টি, বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রার্থীরা ৫৪টি, জামিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) ৩টি ও অন্যান্যরা ৩৩টি আসনে জয় পেয়েছেন।
এ ছাড়া একটি আসনে ভোট স্থগিত করা হয়েছে। ১২টি আসনের ফলাফল ঘোষণা এখনও বাকি আছে। যদিও দেশটির আরেক সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ বলছে, ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা ৯৫টি, পিএমএল-এনের প্রার্থীরা ৭৪টি এবং পিপিপির প্রার্থীরা ৫৪টি আসনে জয় পেয়েছেন। এ ছাড়া এমকিউএম-পি ১৭টি, জেইউআই-এফ ৩টি, পিএমএল ৩টি, আইপিপি ২টি, বিএনপি ২টি, পিএমএল-জেড ১টি, এমডব্লিউএম ১টি, পিএনএপি ১টি, বিএপি ১টি, পিকেএমএপি ১টি এবং এনপি ১টি আসনে জয় পেয়েছে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ২৪৫টি আসনের ফলাফল জানা গেছে। সেখানে দেখা গেছে, ৯৮টি আসনে জয়ী হয়েছেন ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৬৯টি আসন পেয়েছে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৫১টি আসন।
এদিকে পিটিআইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান ব্যারিস্টার গোহর খান গোহর খান দাবি করেছেন, বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ভোটে জাতীয় পরিষদের ২৬৫টি আসনের মধ্যে ১৭০টিতে জিতেছে পিটিআই। শনিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে পিটিআইয়ের এই নেতা বলেছেন, ‘‘আমরা অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে দাবি করছি, পিটিআই এই মুহূর্তে জাতীয় পরিষদের ১৭০টি আসনে এগিয়ে আছে। এর মধ্যে ৯৪টি আসনের ফল ইসিপি স্বীকার করেছে।’’
গোহর আলী খান দেশটির সব প্রতিষ্ঠানকে দলটির ম্যান্ডেটের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়ে ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শনিবার রাতের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ না করা হলে রোববার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করবে পিটিআই।
নির্বাচনে পাকিস্তানের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফ পৃথকভাবে বিজয় দাবি করেছেন। ইমরান খান কারাবন্দি রয়েছেন এবং তার দলকে নির্বাচনে বাধা দেওয়া হয়েছে, তা সত্ত্বেও সর্বাধিক আসনে জয় পেয়েছে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
অর্থনৈতিক সংকট আর গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণের মাঝে জঙ্গি সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করা পারমাণবিক অস্ত্রধারী দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে বৃহস্পতিবার সাধারণ নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ভোটের ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও দেশটির নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করতে পারেনি।
জোট সরকার গঠনে দৌড়ঝাঁপ : নির্বাচনে ভোটের হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) চেয়ারম্যান নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যে সরকার গঠনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে জোট গঠনের তৎপরতাও শুরু করেছেন তিনি। পিএমএলএন চাইছে, নতুন জোট গঠিত হলে সেই জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ শরিফ।কিন্তু ভোটের হিসেবে তৃতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জানিয়েছে, নতুন জোটে যেতে তেমন কোনও সমস্যা না থাকলেও নওয়াজ শরিফকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে দলটির।
পিপিপির শীর্ষ মুখপাত্র খুরশিদ শাহ জিও নিউজকে বলেছেন, নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হতে চান। এজন্যই জোট গঠনের তৎপরতা চালাচ্ছেন। জোট সরকারের অংশ হতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা তাকে (নওয়াজ) প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চাই না। আমরা চাই, পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন আমাদের দলের চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।’সেনাপ্রধানের বিবৃতি : পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনির জাতীয় নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় শনিবার দেশটির নাগরিকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নৈরাজ্য আর মেরুকরণের রাজনীতি থেকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জাতির এখন ‘‘স্থিতিশীল হাত’’ দরকার।
এই নির্বাচন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির আশ্রয়স্থল যাতে হতে পারে, এক বিবৃতিতে সেই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন আসিফ মুনির। এদিকে, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। একই সঙ্গে দেশটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব ধরনের অনিয়মের ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে তারা।