৩ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে দ্বিগুনের বেশী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৫:০৮ অপরাহ্ন
আবারও দাম বাড়ানোর তৎপরতা
জালালাবাদ রিপোর্ট: বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই তৎপরতা আরও আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। মাঝে নির্বাচন থাকায় তা থেমে ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এখন দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে তা জনজীবনে নতুন করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে গত ৩ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশী। কিন্তু আগের ৯ বছরে একসাথে এভাবে বাড়েনি দাম। নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে বিদ্যুতের বাড়তি দাম প্রান্তিক জনগোষ্টীর জন্য মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে টানা ৯ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ৫ টাকার ঘরেই ছিল। তবে সে বৃত্ত ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় সাড়ে ৬ টাকা দাঁড়ায়। পরের দুই অর্থবছর তা আরও লাফিয়ে বেড়েছে। এতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় ১১ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত ৩ বছরে ইউনিটপ্রতি লোকসান হয়েছে ৪ গুণ।বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, এক যুগ আগে ২০১১-১২ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ৫ টাকা ১২ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল ২ টাকা ৯৭ পয়সা। আর অন্যান্য ব্যয় ছিল ২ টাকা ১৫ পয়সা। এর মধ্যে গড় স্থায়ী ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১ টাকা ৯৯ পয়সা এবং গড় পরিবর্তনশীল ব্যয় তথা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ১৬ পয়সা।
এদিকে গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১ টাকা ০৪ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল ৭ টাকা ১১ পয়সা ও অন্যান্য ব্যয় ৩ টাকা ৯৩ পয়সা। অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে গড় স্থায়ী ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩ টাকা ৪৯ পয়সা এবং গড় পরিবর্তনশীল ব্যয় ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ এক যুগের ব্যবধানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েছে ৫ টাকা ৯২ পয়সা। তবে শেষ তিন অর্থবছরেই তা বেড়েছে ৫ টাকা ২৯ পয়সা।
এক দশকের বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ৩ টাকা ১৮ পয়সা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৮১ পয়সা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় সামান্য কমে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৭৮ পয়সা, ২০১৫-১৬ অর্থবছর আরও কমে ৩ টাকা ০৪ পয়সা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছর হয় ২ টাকা ৮৩ পয়সা। পরের অর্থবছর তা আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৪৪ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর আবার কমে হয় ২ টাকা ৯২ পয়সা।
এদিকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র খুব একটা বাড়েনি। ফলে ওই চার বছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় স্থায়ী ব্যয় ছিল ১ টাকা ৮৮ পয়সা। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছর গড় পরিবর্তনশীল ব্যয় ছিল ৩১ পয়সা। তবে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থছর তা কমে দাঁড়ায় ১৯ পয়সা। পরের অর্থবছর তা আরও কমে হয় ১৮ পয়সা।
এর সঙ্গে জ্বালানি ব্যয় যোগ করে ওই চার অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে যথাক্রমে ৫ টাকা ৪৭ পয়সা, ৫ টাকা ৮৮ পয়সা, ৫ টাকা ৮৫ পয়সা ও ৫ টাকা ১০ পয়সা। গত এক যুগের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের গড় ব্যয়ই (৫ টাকা ১০ পয়সা) ছিল সর্বনি¤œ। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় সর্বনি¤œ ব্যয় ছিল ৩ টাকা ৯৫ পয়সা।
তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় স্থায়ী ব্যয় বেড়ে হয় দুই টাকা ১২ পয়সা। পরের অর্থবছর তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় দুই টাকা ৩১ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর দুই টাকা ৪৯ পয়সা। এর সঙ্গে পরিবর্তন ব্যয় গড়ে যোগ হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৬ পয়সা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২০ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২৬ পয়সা। জ্বালানি ব্যয় যোগ করে ওই তিন অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে যথাক্রমে ৫ টাকা ২১ পয়সা, ৫ টাকা ৯৫ পয়সা ও ৫ টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১৯-২০ অর্থবছর করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দামে ধস নামে। এতে ওই অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় কমে দাঁড়ায় মাত্র ২ টাকা ১৩ পয়সা, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে কম গড় জ্বালানি ব্যয়। তবে করোনার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছর গড় স্থায়ী ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ১৩ পয়সা ও গড় পরিবর্তনশীল ব্যয় ৩২ পয়সা। এতে ওই অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ৫ টাকা ৫৮ পয়সা। এটি ছিল গড় উৎপাদন ব্যয় ৫ টাকার ঘরে থাকার শেষ অর্থবছর।
পরের অর্থবছরই গড় জ্বালানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় এক লাফে বেড়ে হয় ৫ টাকা ৩৭ পয়সা। তবে উৎপাদন বাড়ায় ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছর গড় স্থায়ী ব্যয় হ্রাস পায়। ওই দুই অর্থবছর গড় স্থায়ী ব্যয় ছিল যথাক্রমে ২ টাকা ৮৪ পয়সা ও ২ টাকা ৮২ পয়সা। সঙ্গে পরিবর্তনশীল ব্যয় যোগ হয়েছে যথাক্রমে ২৮ পয়সা ও ৩৪ পয়সা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় পড়ে ২০২০-২১ অর্থবছর ৬ টাকা ২৯ পয়সা ও ২০২১-২২ অর্থবছর ৮ টাকা ৫৪ পয়সা।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয়ের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় পড়েছে ৭ টাকা ১১ পয়সা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার দাম বৃদ্ধি এবং দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোকে এজন্য দায়ী করা হয়। যদিও অর্থবছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও কয়লার দাম কমে এসেছে। এর সুফল চলতি অর্থবছর মিলবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
গত অর্থবছর আদানি, রামপালসহ বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এতে জ্বালানি ব্যয়ের সঙ্গে গড় স্থায়ী ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ হারে পরিবর্তনশীল ব্যয়। এ দুটি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৩ টাকা ৪৯ পয়সা ও ৪৪ পয়সা, যা বিদ্যুৎ খাতে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ০৪ পয়সা।
প্রসঙ্গত, গড় উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে ৩ শতাংশ সঞ্চালন লোকসান ও ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলের অংশ যোগ করে নির্ধারণ করা হয় বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় যে হারে বাড়ে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয়ও একই হারে বৃদ্ধি পায়। যদিও উৎপাদন তথা সরবরাহ ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে গড় বাল্ক মূল্যহার সরকার বৃদ্ধি করেনি। এতে গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৪০ পয়সা। যদিও চার বছর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছর এ লোকসান ছিল মাত্র ৯১ পয়সা।