শিক্ষক সংকটে বড়লেখায় ৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৩:১১ অপরাহ্ন
মারুফ হাসান (বড়লেখা থেকে ফিরে): বাংলাদেশ সরকারের নথি অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষ্য হচ্ছে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন করা এবং তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। বড়লেখা উপজেলার ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই লক্ষ্য পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
শিক্ষক সংকটে বড়লেখার ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন পাঠদান ব্যহত হচ্ছে। শিক্ষক সংকট নিরসনের আবেদন করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি আজও। দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষক সংকট দূর করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি সুবিচার করার দাবি অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলের।
চাহিদা থেকে কম শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা এবং যথাযথ পাঠদান খুবই কষ্টকর বলে জানিয়েছেন ভূক্তভোগী প্রধান শিক্ষকরা। এতে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষার মান দিনদিন নি¤œগামী হচ্ছে। ৬ কিংবা ৭ পদ বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের সাথে এই ৪ পদের বিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মানের বিশাল ফারাক। শুধু তাই নয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংখ্যা এবং দূরত্ব বিবেচনায় ডাবল শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালুর যে নির্দেশনা সরকার দিয়েছে তাও এখানে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার দাসেরবাজার ও নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নে ৩টি করে মোট ৬টি, তালিমপুর ইউনিয়নে ২টি এবং বর্ণি ইউনিয়নের ১টিসহ মোট ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থেকে ৪জন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য ১০ মাস পূর্বে ভূক্তভোগী ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণের স্বাক্ষরিত ও তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, এম.পি’র সুপারিশসহ একটি আবেদন পত্র উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মীর আব্দুল্লাহ আল মামুন’র কাছে জমা দিতে গেলে তিনি তা গ্রহন না করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।
জানা গেছে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় মোট ১৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষক সংকটে রয়েছে ৯টি বিদ্যালয়। সেগুলো হলো দাসেরবাজার ইউনিয়নের উত্তর বাগীরপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ধর্মদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চান্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নের উত্তর মাইজগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুফিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাগাডহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালিমপুর ইউনিয়নের দ্বিতীয়ারদেহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বর্ণি ইউনিয়নের রংপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
উপজেলার একাধিক শিক্ষককের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, মানসম্মত শিক্ষাদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বড়লেখা উপজেলায় এখনো ৪ পদ বিশিষ্ট বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে নিয়মিত পাঠদান বিঘিœত হচ্ছে। কোন একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই পড়াশোনার মারাত্মক ব্যঘাত ঘটে। তাছাড়া প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সঠিক পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তারা আরো জানান, নতুন জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলো সবই ৬ শিক্ষক বিশিষ্ট। যার অনেকগুলোতেই শিক্ষার্থী সংখ্যা অল্প। যা অসামঞ্জস্য ও মান সম্মত শিক্ষা অর্জনে অন্তরায়। শিক্ষকদের বদলীর ক্ষেত্রেও চার শিক্ষক বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার। সব ধরনের ক্যাটাগরির বদলীর পর-এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বদলীর সুযোগ পান। ফলে দেখা যায় তাদের কাঙ্খিত বিদ্যালয়ের পদ আগে থেকেই পুরণ হয়ে গেছে। তাছাড়াও বদলী হতে গেলে এসব বিদ্যালয় থেকে স্থলাভিসিক্ত শিক্ষক দিয়ে তারপর বদলী হতে হয়। ফলে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও একধরনের হতাশা বিরাজ করে। বদলী প্রক্রিয়া কঠিন হওয়ায় এসব বিদ্যালয়ে কেউ যেতেও চায়না।
এ বছর থেকে সব বিদ্যালয়কে এক শিফটে রূপান্তরের সরকারি পরিকল্পনা এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু হয়েছে যা অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করে শিক্ষকরা জানান, অবকাঠামোগত সমস্যায় থাকা এবং ৪ শিক্ষক বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।
বিষয়টি মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম’র দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সংকট নিরসনে সরকার কাজ করছে। যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলোতে নিয়োগ দেয়া হবে।
৪ জন করে শিক্ষক নিয়ে বড়লেখায় ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এমন তথ্য জানা নেই উল্লেখ করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন জালালাবাদকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি তাই অনেক তথ্যই এখনো অজানা। তবে যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে তার একটি তালিকা তৈরীর কাজ চলছে। তালিকাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মহোদয়ের কার্যালয়ে পাঠানো হবে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুলগুলো যেন শিক্ষক পায় সে ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে।
বড়লেখা উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বদরুল ইসলামকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি বলেন, শিক্ষক সংকটের কারনে অনেক বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পাঠদান ব্যহত হচ্ছে। তাছাড়া সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডাবল শিফটের পরিবর্তে এক শিফটে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চাহিদার চাইতে কম শিক্ষক নিয়ে চলা স্কুলগুলো। দ্রুত সময়ের মধ্যে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন এই শিক্ষক নেতা।
নিজের ইউনিয়নে ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট নিয়ে দাসের বাজার ইউপি চেয়ারম্যান স্বপন কুমার চক্রবর্তী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বিষয়টি আমার নলেজে ছিলো না তবে এখন জেনেছি, যতদ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বসে কিভাবে শিক্ষক সংকট দূর করা যায় সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।
শিক্ষক সংকটে থাকা উপজেলার ৯টি বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা বললে তারা জানান, শিক্ষক সংকটের কারনে বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যহত হচ্ছে। শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। সব স্কুল ১ শিফটে পরিচালনার সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে তা ‘বাস্তবভিত্তিক নয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেনানা স্কুলগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যাও আছে। এতো রুম নেই যে এক শিফটে সবার জায়গা হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার দিক বিবেচনা করে সর্বাগ্রে শিক্ষক সংকট দুর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান অভিভাবকসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।