কোথাও মিলছেনা সরকারি চিনি!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৯:৩৫:৫১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশীয় আখ থেকে উৎপাদিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) লাল রংয়ের চিনির চাহিদা ব্যাপক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় যন্ত্রপাতি-অবকাঠামো ও উৎপাদন সক্ষমতাসহ সব ধরনের সুবিধা থাকলেও বাজারে সরবরাহ নেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় তৈরি এই চিনির। সব মিলিয়ে গুণগত মানসম্পন্ন এ চিনি রয়ে যাচ্ছে সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে।
এদিকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ তালিকাভুক্ত নির্দিষ্ট কিছু সুপারশপে বিএসএফআইসি এ চিনি সরবরাহ করে থাকলেও চলতি মাসের শুরু থেকেই তা বন্ধ। মোটকথা এখন এ চিনি বাজারে কোথাও নেই।
বিএসএফআইসি বলছে, আখ সংকটে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।গত কয়েকদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের শতাধিক দোকানে সরেজমিন ঘুরে খুঁজেও বিএসএফআইসির চিনি পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে দুইটি দোকানে প্যাকেটজাত আখের লাল চিনি পাওয়া গেলেও তা বিএসএফআইসির চিনি নয়। সেই চিনির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে বিএসএফআইসি।
বিএসএফআইসি তালিকাভুক্ত সুপারশপ স্বপ্ন, মিনা বাজার, আগোরা, চালডালসহ মোট সাতটি প্রতিষ্ঠানকে চিনি দেওয়া হতো। কিন্তু এখন এসব সুপার শপে চিনি সরবরাহ করছে না বিএসএফআইসি।বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় স্বপ্ন সুপারশপ ও শুক্রবার মগবাজারে ‘আগোরা’ সুপার শপে গিয়ে দেখা যায়, তাদের কাছে বিএসএফআইসি চিনি নেই। তারা জানান, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা চিনি পাচ্ছে না। তবে কী কারণে চিনি পাচ্ছে না, তা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের জানা নেই।
২০২৩-২৪ মৌসুমে বিএসএফআইসির দেশীয় আখের চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার মেট্টিক টন। এখন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২৮ হাজার ২৮৩ মেট্টিক টন। এ বছর সর্বোচ্চ উৎপাদন হতে পারে ৩০ থেকে ৩১ হাজার মেট্টিক টন, যা লক্ষ্যমাত্রার দুই তৃতীয়াংশ। এছাড়া যে চিনি উৎপাদন হয়, তার অধিকাংশই যাচ্ছে সংরক্ষিত খাত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে।
বিএসএফআইসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের অধীন নয়টি চিনিকলের মধ্যে মাত্র একটি চিনিকল চালু। বাকিগুলো আখের অভাবে বন্ধ আছে। চালু নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল আর কিছুদিন চলবে। বিএসএফআইসি নয়টি চিনিকলের কথা বললেও প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ১৫টি কলের তালিকা দেখা গেছে।
বিএসএফআইসি বলছে, সারাদেশে তাদের ৫ হাজার ৪৯৪ জন বিভিন্ন ক্যাটাগরির ডিলার রয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় ডিলার দুই হাজার ৬৮৪ জন। উৎপাদন কম থাকায় ডিলাররা ঠিক মতো চিনি পাচ্ছে না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের শাহ মিরান স্টোরের মালিক মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ চিনি সচারাচার পাওয়া যায় না। বছরে তিন চার মাস পাই।’
এখানকার আল আরাবিয়া গ্রোসারি অ্যান্ড চায়নির স্টোরের মালিক মনির বলেন, ‘লাল চিনির চাহিদা অনেক। এটাই অর্জিনাল চিনি। সরকারি কর্মকর্তারা রেশন পেলে আমাদের কাছে কেউ কেউ বিক্রি করে যায়, তা আমরা বিক্রি করি। এছাড়া এ চিনি পাওয়া যায় না।’মালিবাগের গুলবাগের দোকানদার আল আমিন বলেন, ‘লাল চিনি সব সময় পাওয়া যায় না, তাই আনাও হয় না।’বিএসএফআইসির তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান মালিবাগের ‘ডেইলি শপিং’য়ে গিয়ে দেখা যায়, আখের লাল চিনি আছে। এক কেজি পরিমাণ প্যাকেট চিনির দাম ১৭৭ টাকা। তবে বিএসএফআইসির দাবি, এই লাল চিনি তাদের নয়।
বিএসএফআইসির কর্মকর্তারা জানান, ‘ডিলার পর্যায়ে আমাদের খোলা চিনির কেজি ১২৫ টাকা। ডিলাররা ১৩২ টাকা বিক্রি করতে পারবে। আর প্যাকেট চিনি ১৩২ টাকায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেওয়া হয়, তারা বিক্রি করবে ১৪০ টাকা। সুতরাং ডেইলি শপিংয়ের ১৭৭ টাকা দামের চিনি আমাদের না।’
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে বিএসএফআইসি ভবনে গেলে প্রবেশ পথে কথা হয় এক কর্মীর সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে গত এক বছরে কোনো চিনি বের হয়নি। যে পরিমান চিনি উৎপাদন হয় তা সরকারি দপ্তরে চলে যায়।’
২০১৯-২০ মৌসুমে উৎপাদন ভালো থাকায় বাজারজাত ছিল জানিয়ে বিএসএফআইসি সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, ‘এরপর উৎপাদন কমায় আর বাজারজাত করা যায়নি। ২০২২ সালে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করেছি, এরপর আর করা হয়নি। এখন ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে তাও কম।’
চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, ‘চিনি উৎপাদন কম হওয়ায় টিসিবিকে চিনি দেওয়া আটকে আছে। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়েছি।’সচিব আরও বলেন, ‘চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তবে রমজানে চিনি বিক্রি করার পরিকল্পনা আছে।’
দুই সপ্তাহ ধরে প্যাকেটজাত চিনি বিপণন স্থগিত জানিয়ে করপোরেশনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মাযহার উল হক খান বলেন, ‘লোকাল দোকানে আমরা কখনই চিনি দিতাম না। আমাদেও লিস্টেড (তালিকাভুক্ত) স্বপ্ন, মিনা বাজার, আগোরা, চালডালসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সামান্য পরিমাণে শুধু জানুয়ারি মাসে চিনি দিয়েছি।’উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মাযহার উল হক খান বলেন, ‘যে জমিতে ধান চাষ করে, ওই জমিতেই আখ চাষ করা হয়। আগে কৃষকেরা ভালো জমিতে আখ চাষ করতেন। যেহেতু আখ দীর্ঘমেয়াদী ফসল। চাষ করতে ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লাগে। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা ছাড়া আখ চাষ করা সম্ভব না। যার কারণে যতদিন যাচ্ছে আখের চাষ কমে আসছে। ১০০ কেজি আখে মাত্র পাঁচ কেজি চিনি পাচ্ছি। অথচ লক্ষ্য ছিল সাড়ে ছয় কেজি।’
খুচরা বাজারে চিনি দেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত নেই জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সংরক্ষিত খাতের চাহিদাই পূরণ করতে পারছি না। চুক্তিবদ্ধ ডিলারদেরও চিনি দিতে পারছি না। আমরা যে পরিমাণ চিনি উৎপাদন করি তার মধ্যে আমাদের বিপণন প্রক্রিয়া একদম স্পষ্ট।’মাযহার উল হক খান বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সংরক্ষিত খাতে চিনির চাহিদা ১৭ হাজার ৯৮২ মেট্রিক টন। তাদের পুরো বছরের চাহিদা ৩৬ হাজার মেট্রিক টন, যা আমাদের উৎপাদনই নেই। এ জন্য তাদেরকে আমরা চিঠি দিয়ে দিয়েছি- জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের কাছে চিনি না থাকার কারণে তাদের বাইরের সোর্স থেকে কিনতে হবে।’
করপোরেশনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা বলেন, ‘চিনি শিল্প করপোরেশন ভবনের নিচে যে চিনি বিক্রি করা হতো তাও বন্ধ আছে। আসন্ন রমজান থেকে বিক্রি করার পরিকল্পনা আছে করপোরেশনের।’