দমানো যাচ্ছে না মশা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২:০৯:৪৬ অপরাহ্ন
অতিষ্ট নগর বাসী, বিব্রত সিসিক
মুনশী ইকবাল : শীত কমতে না কমতেই সিলেট নগরীতে মশার যন্ত্রণা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কয়েল, এরোসল, মশা নিয়ন্ত্রণের ওষুধ কোনো কিছুতেই দমন করা যাচ্ছেনা মশার আক্রমণ। দিনের বেলা উপদ্রব সামান্য কম থাকলেও বিকেল থেকে বাড়তে থাকে মশার যন্ত্রণা। আর সন্ধ্যার পর রাত যত বাড়ে, তখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয় মশার জ্বালা। মশার এই আগ্রাসী উৎপাতে বিব্রত নগর কর্তৃপক্ষও। তারা বলছে, পুরো নগরে একসাথে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান না চালালে দীর্ঘস্থায়ী সুফল মিলবে না।
মার্চের মধ্যে মশক নিধন অভিযান শুরু করতে না পারলে এপ্রিলে বৃষ্টি শুরু হলে মশা নিয়ন্ত্রণ সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে সিসিক। তাই বিষয়টি নিয়ে তারা বিস্তর একটি কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে সেই পরিকল্পনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এদিকে, নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে নগরীতে মশার উপদ্রব চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মশার যন্ত্রণায় অনেকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সন্ধ্যার দিকে বাচ্চারা পড়তে বসতে পারছেনা। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শীতের শেষে মশার উপদ্রব মাথায় রেখে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কোথাও তাদের এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
নগরীর শামীমাবাদ এলাকার গৃহবধূ সামিরা হক বলেন, মশার এমন চিত্র আগে কখনো দেখিনি। মশার উপদ্রব আগেও ছিল, কিন্তু মশার এত আগ্রাসী অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। কয়েল মানেনা, ওষুধ মানেনা এমন মশা কোথা থেকে এলো। দিনের বেলায়ই দরজা জানালা লাগিয়ে বসে থাকতে হয়, তবুও নিস্তার নেই। সন্ধ্যার পর বাচ্চাদের পড়াতে বসাতে পারিনা মশার কামড়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। মাঝরাতে মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে যায়, জেগে দেখি কয়েল জ¦লছে তবুও মশা কামড়াচ্ছে।
নগরীর দাড়িয়াপাড়ার তুহিন স্টোরের পরিচালক জানান, নগরীতে কয়েকদিন থেকে মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। কয়েল মানছেনা মশা। অনেক ক্রেতা এসে দোকানে কয়েল নিয়ে অভিযোগ দিয়েছেন যে কয়েল কাজ করছেনা। আমরা কয়েল কোম্পানিতে অভিযোগ জানিয়েছি যে কয়েলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিছুদিন আগেও যে কয়েলের প্রশংসা ছিল ক্রেতাদের মুখে সেই কয়েল নিয়েই তারা এখন অভিযোগ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, বাসা বাড়িতে তো দরজা জানালা লাগিয়ে বসে থাকা যায় কিন্তু দোকান হটে তো তা সম্ভব নয়। তাই সবদিক বিবেচনা করে মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে পরিত্রাণ দিতে সিটি কর্পোরেশনের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এদিকে সিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বছরে ৪টি ধাপে পুরো নগরীতে মশক নির্ধন কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল সঙ্কটের কারণে তা ঠিকভাবে করা সম্ভব হয়না। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের পর্যাপ্ত জনবল নেই। এরই মধ্যে বেড়েছে আরো ১৫টি ওয়ার্ড। ফলে মশকনিধনে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় নিয়মমাফিক কীটনাশক প্রয়োগ না করায় মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে একটি এলাকায় ১৫ দিন পর একবার করে স্প্রে এবং এর ১৫ দিন পর ফগার মেশিন ব্যবহার করতে হয়। এভাবে ৪ থেকে ৬ বার স্প্রে করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদী ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রয়োজন মাফিক জনবল না থাকায় সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। স্প্রে করার ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ফগিং করতে হচ্ছে। ফলে অভিযানের সুফল মিলছেনা।
সিসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে আলাপকালে জানা যায়, মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য সিসিকের স্থায়ী কোন জনবল নেই। দৈনিক মজুরীতে লোক নিয়োগ করে চালানো হয় কার্যক্রম। নগরীর ১টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য দৈনিক মজুরী বাবত ৩৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মশক নিধন কার্যক্রম। ৪০০ টাকা রোজে প্রতি ওয়ার্ডে আড়াই থেকে ৩ মাসব্যাপী কার্যক্রমে ৯০ জনকে দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে এই কাজের জন্য বছরে সিসিকের ২৭টি ওয়ার্ডে ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এর কোন সুফল পাচ্ছেনা নগরবাসী।
মশার উপদ্রবের ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মশার উপদ্রব মারাত্মক বেড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু মশক নিধন একটি সমন্বিত অভিযানের ব্যাপার। পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ওষুধ ছিটানো, বন জঙ্গল পরিষ্কার ইত্যাদি সবগুলো একসাথে করতে হয়। তাছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে এক দুই ওয়ার্ড করে মশকনিধন কার্যক্রম চালিয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সুফল আসবে না। এজন্য ৪২টি ওয়ার্ডে একসাথে অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু সেই সামর্থ্য আমাদের নেই।
তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রেরণ করেছি। যে পরিকল্পনায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণসহ মশকনিধন অভিযান, পরিচ্ছন্নতাসহ অনেকগুলো বিষয় যুক্ত করে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত আমরা দু একদিনের মধ্যে মেয়রের সাথে আলাপ করে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। মেয়র বাইরে থাকায় তার সাথে আলাপ সম্ভব হয়নি। তিনি এলেই তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমাদেরকে যে কোনো ভাবেই মার্চের মধ্যে মশার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এপ্রিলে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে মশক নিয়ন্ত্রণ অনেকটা অসাধ্য হয়ে যাবে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, যে কোন কারণে যে কোন মওসুমে মশার বিস্তার বাড়লেও স্প্রে দিলে কমে যাওয়ার কথা। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে এর বিস্তার বেড়েছে। এক্ষেত্রে সিসিকের ব্যর্থতার পাশাপাশি মানুষের অসচেতনতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। নগরীর প্রতিটি এলাকায় ময়লা আবর্জনাবাহী গাড়ি থাকার পরও কিছু মানুষ ড্রেনে ময়লা আবর্জনা ফেলেন। এতে মশার প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষ ছাড়াও নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে বলে তারা মনে করেন।