ভয়াবহ বায়ুদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৮:২৭:৩০ অপরাহ্ন
১৯ দিনের ১২ দিনই শীর্ষে ঢাকা
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশে বায়দূষণ ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিপাকে পড়েছেন শিশু ও বয়স্করা। চলতি মাস অর্থাৎ ১ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণে ১২ দিন শীর্ষ স্থানে অবস্থান করে। যা বিগত সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল ছয় দিন। ৯ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু। তা ছাড়া অস্বাস্থ্যকর বায়ু মানে ছিল চার দিন। আর এক দিন সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বায়ু ছিল। ঢাকার বাতাস এক দিনের জন্যও স্বাভাবিক ছিল না। দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা। বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর থাকলেও বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকার পরিবেশ ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানাগেছে, সোমবারও (১৯ ফেব্রুয়ারী) বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে রাজধানী। সোমবার সকাল ৯টা ৪ মিনিটে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে জানা গেছে এ তথ্য। ঢাকার বায়ুর মানের স্কোর ছিল ৩৩৫। এর অর্থ দাঁড়ায় বায়ু দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। তারা আরও বলেন, বাইরের দূষণ থেকে বাঁচতে জানালা বন্ধ রাখা উচিত। বাইরে গিয়ে শরীরচর্চা না করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বায়ুদূষণ বেশি হলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন সংবেদনশীল গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে আছে বয়স্ক, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও জটিল রোগে ভোগা মানুষ। তাদের বিষয়ে বিশেষ যতœবান হওয়া দরকার।
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, বিগত আট বছরের মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে গড় বায়ুমান সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ হলো ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস শীতের মৌসুম এবং এই সময়ে দূষক নির্গমনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু, তাই এই সময়ে ধুলোবালির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। পাঁচ মাসে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে সারা বছরের প্রায় শতকরা ৫৭ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। অপরদিকে বর্ষাকালে (জুন, জুলাই, আগস্ট) বায়ুদূষণ অপেক্ষাকৃত কম পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্ষাকালে ইটের ভাটাগুলো বন্ধ থাকে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুদূষণের পরিমাণ কমে আসে। বর্ষা বা প্রাক-বর্ষাকালীন অবশিষ্ট সাত মাসে ৪৩ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আবার গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ মার্চ থেকে এপ্রিল এবং মে মাসের দিকে দূষণের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে দেখা যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো— ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১৬ সাল থেকে বায়ুদূষণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি বিভিন্ন নির্মাণকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। বায়ুদূষণের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়, কারণ এটি চলমান প্রক্রিয়া। গত আট বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল। গত বছরের বর্ষা মৌসুমেও বায়ুদূষণের উচ্চ মাত্রা লক্ষ করা গেছে। তা ছাড়া চলতি বছরের শুরু থেকেই বায়ুদূষণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাইকোর্ট থেকে নিময় মেনে নির্মাণকাজ করার কথা বললেও কেউ তা মানছেন না। ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমানো জরুরি। গণপরিবহনকে উন্নত করতে পারলে বায়ুদূষণ কিছুটা কমানো যাবে। বিশেষ করে ইটের ভাটাগুলো নিজেদের মতো চলছে। যার ফলে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। বাংলাদেশে সতর্কতা জারি করা জরুরি। দূষণের বদনাম কিংবা জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে কি-না, সে বিষয়টি মাথায় রেখে হয়তো তারা সতর্কতা জারি করছে না।
বায়ুমান সূচকে ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। যে নম্বরের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিগুলো নির্ধারিত হয়। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম-২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। নম্বর নির্ধারিত হয় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে।
সাধারণত বায়ুদূষণকে মানদ- হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বায়ুর মান ৫১ থেকে ১০০ স্কোর মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক বিবেচিত হয়।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ ব্যবস্থা। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বায়ুদূষণের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। রাজধানী ঢাকার মেগা প্রকল্প ও যত্রতত্র কনস্ট্রাকশনের কার্যক্রম ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এই সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া গণপরিবহনের কালো ধোঁয়া ও যানবাহনের কারণে সৃষ্ট ধুলাবালিও বাতাসের মানকে কমিয়ে আনে। বায়ুদূষণের সব চেয়ে বড় কারণ ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধুয়া। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, রাজউক কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলেই আজ এ অবস্থা। শহরে পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তার দৃশ্য চোখে পড়ে না। সরকারি-বেরসকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ম বহির্ভূত কাজের জন্য বায়ুদূষণ বাড়ছে। কনস্ট্রাকশনের কাজের সময় যেন বায়ুদূষণ না হয় সেদিকে খেয়াল থাকা জরুরি। কিন্তু কোথাও তা দেখা যাচ্ছে। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য আইন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’