আগ্রাসী প্রচারে মায়েরা ঝুঁকছেন ফর্মুলা দুধে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৮:৫৯:১৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মাকেই শিশুকে ফর্মুলা দুধ পান করানোর পরামর্শ দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। অথচ তাঁদের ৯৮ শতাংশই শিশুকে বুকের দুধ দেওয়ার পক্ষে। তবে ফর্মুলা দুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন কার্যক্রম ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
এই তথ্য উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক জরিপ প্রতিবেদনে। জরিপে অংশ নেওয়া বাবা-মা ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ৫১ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ফর্মুলা দুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর বিপণন কার্যক্রমে প্রভাবিত হয়েছেন। ‘ফর্মুলা দুধের বিপণন কীভাবে শিশুকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন করা হয়েছে বাংলাদেশসহ আটটি দেশে বাবা-মা, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে। অন্য সাতটি দেশ হলো চীন, মেক্সিকো, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনাম।
জরিপে দেখা গেছে, অনৈতিক বিপণন কৌশল ব্যবহার করে ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ফর্মুলা দুধের এই বাজার টিকিয়ে রাখতে বাবা-মায়েদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে কোম্পানিগুলো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ নারী তাঁদের সন্তানকে পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়ান। প্রায় ৬০ শতাংশ নারীকেই ফর্মুলা দুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তবে এই নারীদের ৯৮ শতাংশই শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছার কথা জানান।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের উপপ্রতিনিধি ভিরা মেন্ডনকা বলেন, বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান। তবে তাঁরা প্রায়ই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সমর্থন পান না। ফর্মুলা দুধ বিপণনের বার্তাগুলো ভয় ও সন্দেহের বীজ বপন করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জরিপ করা সব দেশেই বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রচারমূলক উপহার, বিনা মূল্যের নমুনা, গবেষণার জন্য তহবিল, অর্থের বিনিময়ে সভা, ইভেন্ট ও সম্মেলন আয়োজন এবং কমিশন দেওয়ার মাধ্যমে নতুন মায়েদের ফর্মুলা খাদ্যের বিষয়ে পরামর্শ দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রলুব্ধ করে বিপণন কোম্পানিগুলো, যা বাবা-মায়েদের সিদ্ধান্তকে সরাসরি প্রভাবিত করে। জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশের বেশি নারী বলেছেন, স্বাস্থ্যকর্মী তাঁদের একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ফর্মুলা খাবারের বিষয়ে সুপারিশ করেন।
শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শফি আহমেদ মুয়াজ বলেন, জন্মের প্রথম ঘণ্টায় বুকের দুধ খাওয়ানো, এরপর ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো এবং দুই বছর বা এর বেশি সময় মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে শিশুর শীর্ণকায় বা স্থূলতায় আক্রান্ত হওয়াসহ সব ধরনের অপুষ্টির বিরুদ্ধে শিশুর শরীরে শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। মায়ের দুধ শিশুদের প্রথম টিকা হিসেবেও কাজ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্য বিপণনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানছে না কোম্পানিগুলো। অথচ কোডটি শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারকদের আগ্রাসী বিপণন কার্যক্রম থেকে মায়েদের রক্ষা করতে ১৯৮১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদে পাস হওয়া একটি যুগান্তকারী জনস্বাস্থ্য চুক্তি।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. বারদান জাং রানা বলেন, ফর্মুলা দুধের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী বিপণনের মিথ্যা দাবি থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে নিজস্ব আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশসহ আট দেশের শহরগুলোতে ৮ হাজার ৫০০ জন বাবা-মা ও অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং ৩০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর এই জরিপ চালানো হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের নারীদের ৯২ শতাংশ এবং চীনের নারীদের ৯৭ শতাংশ ফর্মুলা দুধের বিপণন কৌশলে প্রভাবিত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ড. তেদরোস আধানোম গ্রেবেয়াসুস বলেন, এই প্রতিবেদন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ফর্মুলা দুধের বিপণন এখনো অগ্রহণযোগ্যভাবে ব্যাপক, বিভ্রান্তিকর এবং আগ্রাসী। এ জন্য শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় সুযোগসন্ধানী বিপণনের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে হবে।
জরিপ করা সব দেশের নারীরাই তাঁদের শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ, ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনি¤œ মরক্কোতে ৪৯ শতাংশ। কিন্তু বিপণন কোম্পানিগুলো শিশুর বিকাশ বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন কাল্পনিক প্রচারে ফর্মুলা দুধের প্রতি মায়েদের আকৃষ্ট করে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘আমরা জানি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশু ও মা উভয়ের জন্যই সর্বোত্তম। তাই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য কঠোর নীতিমালা, আইন ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।’