ফসল রক্ষা বাঁধ : শেষ হলোনা কাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১:০০:৫৭ অপরাহ্ন
*পাউবোর দাবী ৮৪%, হাওর বাচাও বলছে ৫০%
* সময় বৃদ্ধির আবেদন
এমজেএইচ জামিল : সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজের নির্ধারিত সময়সীমা গতকাল বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) শেষ হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবোর দাবি, জেলায় বাঁধের কাজ গড়ে ৮৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে আরও ৭ দিন সময় লাগতে পারে। এজন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হয়েছে। হাওর আন্দোলনের নেতারা পাউবোর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলছেন, হাওরে বাঁধের কাজ অর্ধেকের বেশি হয়েছে বলা যাবে না। কোনো কোনো হাওরে তার চেয়ে কম কাজ হয়েছে।
প্রবল বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওরবেষ্টিত জেলা সুনামগঞ্জে প্রায় প্রতি বছরই দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চ মাসের দিকে শুরু হওয়া এই বন্যার পানি জেলার হাওরের কৃষকদের বোরো ধান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ধান রক্ষা করতে প্রতি বছর সরকারি অর্থায়নে হাওরে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার নীতিমালা অনুযায়ী এসব ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ গত ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা। সে হিসেবে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাদবাকি কাজ এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। এজন্য ৭দিন সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে হাওর বাঁচাও আন্দোলন নেতাদের দাবি, কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় আগাম বন্যা নিয়ে শঙ্কিত হাজারো কৃষক।
এদিকে এবার ফসল রক্ষা বাধের কাজের ধীরগতির পাশাপাশি নি¤œমানের কাজের অভিযোগ উঠছে। কাজ শেষ হওয়ার আগেই কয়েকটি উপজেলার বেশ কিছু বাঁধে ধস ও ফাটলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কৃষকরা জানান, বাঁধের ওপরে ও দুদিকের ঢালে দূর্বা ঘাস না দেওয়া এবং মাটি পিটিয়ে (দুরমুশ) শক্ত না করায় এমন ঘটনা ঘটছে।
ভুক্তভোগী কৃষকরা এবং হাওর বাঁচাও আন্দোলন নেতারা বলেন, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে প্রতি বছরই নির্মাণ কিংবা সংস্কার করা হয় কয়েকশ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ। আর প্রতিবারই এ কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। যে বছর বৃষ্টিপাত ও ঢল বেশি হয়, সেই বছর ফসলের ক্ষতিও হয় বেশি।
সুনামগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। যার ওপর নির্ভরশীল জেলার প্রায় ৪ লাখ কৃষকের জীবন-জীবিকা। যে কারণে গণ-শুনানির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন শেষে এই পিআইসির মাধ্যমে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ করানো হয়। পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধের মধ্যে ৫৮১ কিলোমিটার বাঁধে ৭৪১টি পিআইসির মাধ্যমে ১২৬ কোটি টাকার মাটির কাজ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা এবং হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এ বছরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এক সপ্তাহ সময় বাড়িয়েও কোনোভাবেই বাঁধের বাদবাকি কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। কাজ চলছে ধীরগতিতে। আর এই ধীরগতির কারণ অজুহাত হিসেবে প্রথমে বলা হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে। ওই সময় প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট লোকজন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাজ কিছুটা পিছিয়েছে বলে দাবি করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন এবং শ্রমিকরা নির্বাচন নিয়ে মেতেছিল। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন শেষের ১ মাস ২১ দিন পার হলেও কাজে তেমন গতি আনতে পারেনি পাউবো।
কৃষকরা বলছেন, প্রতি বছরের মতো এবারও পাউবো কাজ শেষ করতে সময় বাড়াবে। কিন্তু এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে অনেক ফসলরক্ষা বাঁধ। যে বাঁধগুলোর কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোতেও দুরমুশ দিয়ে মাটি শক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া বাঁধের মাটি যাতে সরে না যায়, সে জন্য দেওয়া হয়নি দূর্বা ঘাস। এই ঘাস না দেওয়ায় ইতিমধ্যে কয়েকটি উপজেলার বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে শান্তিগঞ্জ উপজেলার ছাইয়ার হাওর কিত্তার ফসলরক্ষা বাঁধ এবং জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া ও মইয়ার হাওর ফসলরক্ষা বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল।
তবে বাঁধে ধস বা ফাটলের অভিযোগ মানতে নারাজ সুনামগঞ্জ পাউবোর কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বাঁধের মাটি সামান্য সরেছে। এগুলো দ্রুতই ঠিক করা হবে। একই সঙ্গে আরো ৭ সময় পেলে বাকী ১৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যাবে।
জেলায় ইতিমধ্যে শতভাগ জমিতে ধান রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় এবং বাঁধে ঘাস না দেওয়ায় ফসলরক্ষা নিয়ে চিন্তা যেন শেষ হচ্ছে না কৃষকদের। শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরের কৃষক আব্দুল কাদির বলেন, আমরা অনেক টাকা খরচ করে ধান রোপণ করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় আতঙ্কে আছি। বাঁধ শক্ত করতে দুরমুশ দেওয়া এবং বৃষ্টির পানি যাতে সরাসরি বাঁধের মাটিতে না পড়ে, সে জন্য দূর্বা ঘাস দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এবার যদি আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙে যায় তাহলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। অন্যবছর থেকে এবার কাজ হয়েছে আরো নিম্নমানের। বন্যা দূরে থাক বৃষ্টি পানিতেই এই বাধঁ টিকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরাঞ্চলের মানুষের একমাত্র ফসল নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তারা বলেছিল, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করবে। কিন্তু তারা আমাদের হিসেবে এখনো ৫০ শতাংশ কাজই শেষ করতে পারেনি। আমরা ২৯ ফেব্রুয়ারির পর জেলাব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেব। এমনকি জনস্বার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারি। কৃষকদের জীবন নিয়ে তাদের আর ছিনিমিনি খেলতে দেয়া যাবেনা। এই বোরো ফসল অনেক কৃষক পরিবারের সারা বছরের আয়। এই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। কিন্তু অকাল বন্যায় যদি ২০১৭ ও ২০২২ সালের মতো আবারও বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায় তাহলে কৃষকরা পথে বসে যাবে। তাই ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করার বিকল্প নেই।তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছি। বৃহস্পতিবার থেকে স্মারকলিপি মানববন্ধনসহ লাগাতার কর্মসূচী ঘোষণা করবো। প্রয়োজনে পাউবোর বিরুদ্ধে মামলাও করবো।
এবারের ফসল রক্ষা বাঁধ অন্যান্য যে কোন বছরের থেকে খারাপ হয়েছে। এবার পিআইসি গঠনে অনিয়মসহ পুরনো রাস্তার মাটি কেটে এর পাশে বাঁধ নির্মাণের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। সামান্য বৃষ্টিপাতে বাঁধ ধসে গেছে। এসব হাওর পাড়ের মানুষের জন্য অশনি সংকেত। আমরা কোন ছাড় দিবোনা। ফসল রক্ষার দাবীতে কঠোর কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামবো।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলায় ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ১ সপ্তাহ সময় বাড়ানোর দাবীতে চিঠি দিয়েছি। এক সপ্তাহ সময় পেলে পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে। জেলার অধিকাংশ উপজেলায় কাজ শেষ হওয়ার পথে শাল্লা, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় কাজ একটু বেশী বাকী রয়েছে। তবে তা ৭দিনে শেষ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, কোথাও বাঁধে ধস হয়নি। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছি। সামান্য মাটি সরেছে, এগুলো দ্রুত ঠিক করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৪ শতাংশ বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। ৭দিন সময় পেলে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারব। আর কাজের সময় বাড়াতে হবে না। মাজখানে কাজ কিছুটা ধীরগতিতে হলেও এখন পুরোদমে চলছে। কোথাও কোনো গাফিলতি পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি।