ঢাকার বেইলি রোডে ভয়াবহ আগুন, নিহত ৪৫
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মার্চ ২০২৪, ৫:৪০:২৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সামনে রেখে আগের দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের রেস্তোরাঁগুলোতে আড্ডা জমেছিল বেশ। কফির কাপে চুমুকে কর্মব্যস্ত দিনের ক্লান্তি দূর করছিলেন কেউ কেউ। হঠাৎ করেই সেখানে ‘গ্রিন কজি কোট শপিংমলে’ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। ওই ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর ভোজনরসিকদের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ঝাঁপ করলেও সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় নারী ও শিশুসহ ৪৫ জনের মরদেহ। লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সেখানে আহাজারি করেন স্বজন।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে ভবনটিতে তারা আগুন লাগার খবর পান। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে রাত ২টা পর্যন্ত ৪৩ জনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাদের হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। নিহতদের মধ্যে ২১ নারী ও চার শিশু রয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।
সাততলা ওই ভবনটি শপিংমলের সাইনবোর্ড থাকলেও এর তলায় তলায় নানা নামের খাবার দোকান আর রেস্তোরাঁ রয়েছে। ‘কাচ্চি ভাই’, ‘পিৎজা ইন’সহ বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান এ ভবনে। আগুন জ্বলার সময়ে লোকজন খাচ্ছিলেন এসব রেস্তোরাঁয়। তাদের চোখের সামনেই ‘যমদূত’ হয়ে আসে ভয়াবহ আগুন, তাতে ভেতরে অনেকে আটকা পড়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন তখনো।
রাত ২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভবনটিতে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা না গেলেও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে ভবনের ফ্লোরগুলো। আগুন লাগার কারণ নিশ্চিত না হলেও ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, কোনো রেস্টুরেন্টের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এক সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, আগুনে ৪৫ জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় নিয়ে এলে ৩৩ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ১০ জন দগ্ধ অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান। আরও কয়েকজন বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তারাও শঙ্কামুক্ত নন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় আগুন লাগে। দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর তা ওপরের তলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত লোকজন ওপরের দিকে উঠে যায়। এ সময় ভবন থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে কয়েকজন আহত হন।
এক সময়ের নাটক ও সংস্কৃতির কেন্দ্র বেইলি রোড এখন নানা ব্র্যান্ডের পোশাক আর খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁর জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানকার প্রায় সব ভবনই বহুতল, ওপরের তলাগুলো আবাসিক হলেও ৫ থেকে ৬ তলা পর্যন্ত শপিংমল। গ্রিন কজি কোট শপিংমলের আগুনে পুরো এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন জ্বলতে থাকা ভবনটির দুই পাশের ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের ডিজি ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তারা উদ্ধার কার্যক্রম তদারকি করছিলেন।ঘটনাস্থলে পুলিশ, বিজিবি, সেনাবহিনী ও আনসার সদস্যরা নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি উদ্ধার সহায়তা করেন ফায়ার সার্ভিসকে। তবে বরাবরের মতো উৎসাহী লোকজনের ভিড় সামলে উদ্ধার কাজ চালাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার ফাইটারদের।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ইনচার্জ শাহজাহান শিকদার জানান, তারা রাত ১০টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পান। এর চার মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পরে আগুনের ভয়াবহতা দেখে ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হয়। তিনি জানান, আগুন লাগার কারণ বা উৎপত্তিস্থল তাৎক্ষণিক জানা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, সাততলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়লে রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকা মানুষজন আটকে পড়ে। তারা নিচের দিকে নামতে না পেরে ছাদে চলে যান। পরে ফায়ার সার্ভিস তাদের পর্যায়ক্রমে নামিয়ে আনে।
উদ্ধার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কিত হয়ে কয়েকজন নিচে লাফিয়ে পড়েছেন। ভবনের পেছনের অংশ দিয়ে পাইপ বেয়ে নেমেছে অনেকে। ভবনের কোনো অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছিল না— এমন অভিযোগ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘দ্বিতীয় তলা ছাড়া, এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়িতে ছিল সিলিন্ডার, যেটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ আগুন লাগলে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, যা ভয়ংকর, বিপজ্জনক। ভবনটা মনে হয়েছে অনেকটা আগুনের চুল্লির মতো। তিনি আরও বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখছি ভবনটি কত বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই ভবনে মাত্র একটি সিঁড়ি।
এর আগে বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ার, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ও নিমতলীতে আগুন লেগে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।