খতনা নিয়ে অভিভাবকমহলে শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মার্চ ২০২৪, ৮:৫৮:৩১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: নগরীর সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা হেনা বেগম। তার ছোট ছেলের বয়স ৬ বছর। এ বছরই মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন। আসন্ন রমজানে মাদ্রাসা বন্ধের সময় ছেলেকে খতনা করাবেন বলে পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি দেশে খতনা করাতে গিয়ে হাসপাতালে দুই শিশুর মৃত্যুতে তিনি শঙ্কিত। তিনি বলেন, হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। ছোট ছেলেও এসব দেখে খতনা করাতে ভয় পাচ্ছে।
নগরীর পাঠানটুলা এলাকার সৌরভ আহমদ একজন মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছেন। আসন্ন রমজানে স্কুল বন্ধ থাকায় ৫ বছর বয়সী ২য় ছেলের খতনা করাতে হাজামের সাথে কথা বলছেন। গত জানুয়ারী মাসে ঐ হাজামের মাধ্যমে তার ৭ বছর বয়সী ১ম ছেলের খতনা করিয়েছেন। হাজামের পরামর্শে খতনা পরবর্তীতে ওষুধ খেয়ে তার ছেলে ভাল হয়েছে।তিনি বলেন, ২য় ছেলের খতনা নিয়ে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম হাসপাতালে নিয়ে ছেলেকে খতনা করাব। খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর পর আর হাসপাতালে নিয়ে খতনা করানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। এখন হাজামকে দিয়েই খতনা করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সাম্প্রতিক সময়ে খতনা করাতে গিয়ে সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ান ও মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আয়হাম নামে দুই শিশু মৃত্যুর পর খতনা নিয়ে এমনই আতঙ্ক দেখা গেছে অভিভাবকদের মধ্যে।নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ঘুরে অভিভাবকদের সাথে কথা বলে খতনা নিয়ে এমন আতঙ্কের কথা জানা গেছে। অভিভাবকদের কেউ কেউ হাসপাতালে আধুনিক খতনা পদ্ধতি থেকে সরে এসে পুরোনো হাজাম পদ্ধতিতে খতনার কথা ভাবছেন।
তবে খতনা নিয়ে দেশে আতঙ্ক শুরু হয় মূলত গত ডিসেম্বর মাসে। সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঁচ বছরের শিশু আয়ানকে খতনা করাতে নিয়ে আসেন তার বাবা। খতনা করানোর সময় অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে আর জ্ঞান ফেরেনি শিশু আয়ানের। পরে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হয়নি। আট দিন অচেতন থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি রাতে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনার ঝড় তোলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। খতনা নিয়ে আরও আতঙ্ক বাড়ে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়হামকে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যুতে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আয়হামকে সুন্নতে খতনা করাতে নিয়ে যান তার বাবা ফখরুল আলম। স্থানীয় অ্যানেস্থেসিয়া না দিয়ে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয় শিশুটির শরীরে। এতে খতনা করানোর পর আর জ্ঞান ফেরেনি শিশুটির। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও সন্তানকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের না করায় তিনি নিজেই অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেন। গিয়ে দেখেন সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে। নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এরপর ফখরুল আলমকে ওটি থেকে বের করে দেন চিকিৎসকরা। দুই ঘণ্টা পরে জানানো হয় আয়হামের মৃত্যু হয়েছে। পরে হাতিরঝিল থানায় চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলায় জেএস হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে আসামি করা হয়। চিকিৎসক দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঘটনা দুটির পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতাল ক্লিনিকের ক্ষেত্রে ১০টি নির্দেশনা জারি করা হয়। যেকোনো ধরনের অপারেশন বা প্রসিডিউরের জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপারেশন/সার্জারি/ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিউর করা যাবে না। সব বেসরকারি নিবন্ধিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে লেবার রুম প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার শিষ্টাচার মেনে চলাতে হবে।
অ্যানেস্থেসিওলজিস্টরা বলছেন, অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর যত দুর্ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে শর্ট কেসের (ছোট অপারেশন) ক্ষেত্রে। সারাবিশ্বে যদি বছরে ভুল অ্যানেস্থেসিয়ায় পাঁচ হাজার মানুষেরও মৃত্যু হয়, সেখানে দেখা যাবে সাড়ে ৪ হাজারই ছোট কেস আর অবহেলায় মৃত্যু। শিশুদের অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর চেকআপ করতে হয়। বারবার অবজারভেশন করতে হয়। কেন মৃত্যু হচ্ছে এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। অবশ্যই পেশাগতভাবে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট দিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে দুই শিশুর মৃত্যু ও খতনা ব্যবস্থা নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের দেশে খতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি বছর লাখ লাখ খতনা হচ্ছে দেশে। কিন্তু খতনা করানো নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এতে করে কারা কিভাবে খতনা করাচ্ছেন এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। খতনা নিয়ে একটি নীতিমালা হওয়া জরুরি। খতনা করাতে গিয়ে কোনো শিশুর মৃত্যু হলেই ডাক্তারকে দোষারোপ করা যাবে না। সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজতে হবে। কোনো শিশুর মৃত্যুই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আমি জানিনা। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এমবিবিএস পাশ যে কোন ডাক্তার একটু সতর্ক থাকলেই খতনা করতে সক্ষম। তাই দুয়েকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য বিভ্রান্ত না হয়ে হাজামের চাইতে ডাক্তারদের দ্বারা খতনা করানো উত্তম।