চা-বাগানে বাড়ছে কুষ্ঠ রোগী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০২৪, ৮:৪৩:২৬ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: বাংলাদেশের যেসব জেলায় কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এরমধ্যে চা-বাগান অধ্যুষিত মৌলভীবাজার উল্লেখযোগ্য। গেল ২০২৩ সালে এ জেলায় মোট ২৫৭ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১১ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষার হার বাড়ালে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বে। তবে জেলা সিভিল সার্জন অফিস জানিয়েছে, বর্তমানে এ জেলায় কুষ্ঠ রোগের পরিস্থিতি ভালো। চা-বাগানসহ সন্দেহজনক এলাকায় পোর্টেবল এক্সরে দিয়ে রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা। সম্প্রতি মৌলভীবাজারে কুষ্ঠ রোগের একটি চিত্র তুলে ধরেছে রোগটি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লেপ্রা। সংস্থাটির মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জের এরিয়া সুপারভাইজার জিয়াউর রহমান মৌলভীবাজারের কুষ্ঠ রোগের অবস্থা নিয়ে আশঙ্কাজনক কিছু তথ্য জানিয়েছেন।
লেপ্রা জানিয়েছে, ২০২২ সালে মৌলভীবাজারে মোট কুষ্ঠ রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৯৩ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৭ জনে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়। এ উপজেলায় ২০২৩ সালে ৬৬ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হন। একই বছর কুলাউড়ায় ৬২ জন, জুড়ীতে ৪৬ জন, শ্রীমঙ্গলে ৩৫ জন, বড়লেখায় ২৬ জন, রাজনগরে ১৭ জন এবং সদরে মোট ৯ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হন। এ বিষয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘মৌলভীবাজারে মোট শনাক্ত হওয়া কুষ্ঠ রোগীর বেশির ভাগই পিছিয়ে থাকা চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। মোট কুষ্ঠ রোগীর ৯৮ শতাংশই আসেন জেলার বিভিন্ন চা-বাগান থেকে। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে, চা-বাগানগুলোতে সহজেই রোগীদের পরীক্ষার জন্য একত্র করা যায়। তাই পরীক্ষাও হয় বেশি। যে কারণে শনাক্তের হার চা-বাগানে বেশি।’ তিনি জানান, সিভিল সার্জনের উদ্যোগে পোর্টেবল এক্সরে সুবিধা চালু করায় এখন এক্স-রে টিম নিয়ে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায়ও রোগী শনাক্ত করা হয়। টিমটি যেখানে যায়, সেখানে ক্যাম্পেইনও করে। আমরা সার্ভে বাড়াতে পারলে কুষ্ঠ রোগী শনাক্তের সংখ্যা আরও বাড়বে।
চা-শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মীদের থেকে জানা যায়, শ্রমিকদের মজুরি কম থাকার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে কম খাওয়ার ফলে তারা অপুষ্টিতে ভোগেন। এ ছাড়া তারা নোংরা পরিবেশে বসবাস করেন। এসব কারণে তাদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ হওয়ার হার বেশি। পরিবারের কোনো সদস্যের এই রোগ হলে অন্যরা তা বুঝতেও পারেন না। তার মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হয়।মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা মো. আব্দুল জাকারিয়া বলেন, ‘জেলায় ২০২৩ সালে ২৫৭ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এরমধ্যে চিকিৎসার আওতাধীন রয়েছেন ২১৭ জন। তাদের মধ্যে শিশু ১১ জন। মারা গেছেন দু’জন। বাকিরা সুস্থ হয়ে গেছেন।
আক্রান্তের এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক জানিয়ে তিনি বলেন, কুষ্ঠ রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সিভিল সার্জন অফিসের উদ্যোগে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকদের দল সার্ভে করছে। সচেতনতামূলক ক্যাম্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে জানানো হচ্ছে।
কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত রোগী বিনয় চাষা বলেন, ‘আমি জানতামই না, আমার কুষ্ঠ হয়েছে। শুধু পায়ে কিছু ঘা হয়েছিল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাই। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ঘা কম ছিল না। পরে চা-বাগানের এক ডাক্তার জানান, আমার কুষ্ঠ হয়েছে। পরে তিনি আরও দু’জন ডাক্তার নিয়ে আসেন। তারা আমাকে চিকিৎসা দেন। প্রায় এক বছর ওষুধ খাই। এতে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। পরে আরও ছয় মাস ওষুধ খাওয়ার পর এখন মোটামুটি সুস্থ আছি।’
চা বাগানের এক নারী বলেন, ‘আমার পিঠে প্রথমে একটা দাগ হয়েছিল। সেই দাগ শুরুতে আমলে নেইনি। কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও যখন এটি কমেছিল না, তখন ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি জানান, আমার কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। তবে এখন চিকিৎসাধীন আছি। ডাক্তার বলেছেন, ওষুধ খেলে কুষ্ঠ রোগ ভালো হয়ে যায়।’জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মোর্শেদ বলেন, কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের দিক দিয়ে দেশে শীর্ষ জেলা মৌলভীবাজার। বর্তমানে জেলায় যেসব রোগী রয়েছেন তাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্করাই বেশি। সংক্রামক এ রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার রয়েছে। অধিকাংশ রোগী সমাজ ও নিজের পরিবারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আমরা চিকিৎসার পাশাপাশি রোগী ও তাদের পরিবারকে সচেতন করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বাস্থ্য বিভাগ সক্রিয় রয়েছে। শনাক্ত কুষ্ঠ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।