শুধু ইফতারীতেই ব্যয় বাড়ছে ৪০%
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:১০:৫৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: রমজান আসে সুসংবাদ নিয়ে। পুরো বছরের সংযমের শিক্ষা দিয়ে বিদায়ও নেয়। সবাই কমবেশি শিক্ষা নেয়, শুধু দেশের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ছাড়া। আর এসব ব্যবসায়ীর কারণেই ইফতারের অপরিহার্য খাদ্যপণ্যগুলো যেন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে। দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছায়, এবারের রোজায় সাধারণ মানুষকে খাবারেও ত্যাগ করতে হবে। রোজাদারদের একটু স্বস্তি দিতে কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে সরকার শুল্ক-ভ্যাটে ছাড় দিলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি; বরং এবার রোজার আগে থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার শুধু রোজায় ইফতার সারতেই ব্যয় বেড়ে যাবে অন্তত ৪০ শতাংশ। কারণ সারাবিশ্বে রোজায় মুসল্লিরা খাবারের পেছনে একটু বেশিই ব্যয় করেন। গবেষণা বলছে, সারাবছরে মুসল্লিরা খাবারের পেছনে যে ব্যয় করেন, এর ১৫ শতাংশই যায় রোজার মাসে। তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় এবার দেশে খাবারের দাম আরও বেশি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যেই সব খাবারের দাম বেড়েছে। রোজায় আনুষঙ্গিক অনেক পণ্যের দামই দুই বছরের ব্যবধানে ৫০ থেকে শতভাগ কিংবা তারও বেশি বেড়েছে।
রোজায় ইফতার সারতে চারজনের একটি পরিবারে প্রায় সাড়ে চার কেজি চিনি খরচ হতে পারে। এতে ব্যয় হবে ৬৩০ টাকা। ভাজাপোড়ায় অন্তত পাঁচ লিটার তেল প্রয়োজন হয়, খরচ হবে ন্যূনতম ৮০০ টাকা। এর বাইরে ছোলা, ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ ইফতারির ভাজাপোড়ার অন্যান্য পণ্যে আরও প্রায় ৪ হাজার ৭০ টাকা ব্যয় হবে। ফল কিনতে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে চারজনের একটি পরিবারের ইফতার সারতে রমজান মাসে ন্যূনতম খরচ হতে পারে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ টাকা, যা গত বছর ছিল প্রায় ৬ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলমের ভাষায়, ‘অতি মুনাফাকারী’ যাতে এবার একটু কম মুনাফা করেন। এফবিসিসিআই প্রতি বছর রমজানের আগে ব্যবসায়ীদের নিয়ে ‘লোকদেখানো’ মতবিনিময় সভায় বসে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হম্বিতম্বিই সার, আদতে বেলা শেষে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার মৌসুম হিসেবেই দেখেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ; অর্থাৎ খাবারের যে পণ্য আগের বছরের জানুয়ারিতে ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, গত জানুয়ারিতে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৫৮ পয়সায়। খাদ্যপণ্যের বাজারে আদতে আগুন; বিশেষ করে ইফতার ও সাহরির খাদ্যপণ্য কিনতে মাথায় হাত ভোক্তার।এতটুকুও রোজাদারের জন্য কষ্টকর হতো না, যদি গড় মজুরি মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি হতো। ২৪ মাস বা দুই বছর ধরে দেশে মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। আরেকটু হিসাব করে বললে, জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বিপরীতে দেশে গড় মজুরি বাড়ে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ; অর্থাৎ মানুষের গড় আয় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৭ টাকা ৭৭ পয়সা, বিপরীতে পণ্যের দাম বেড়েছে ৯ টাকা ৮৬ পয়সা। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই হিসাব বাস্তবসম্মত নয় বলে ধারণা করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি বলে ধারণা তাদের। অর্থনীতির পরিভাষায়, মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি কম হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, ঋণ করে চলতে হয়।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘পণ্যমূল্য কখনোই স্থির থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডলারের উচ্চ মূল্যস্ফীতি তো আছেই। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে বছর দেড়েক আগে। পৃথিবীর অনেক দেশই মুদ্রাস্ফীতির হ্রাস টানতে সক্ষম হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা না গেলে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের দাম কমার আশা করাটা বোকামি।’তিনি আরও বলেন, ‘সরকার তো চেষ্টা করছে। একই সময় সরকার র্কর্তৃক সরবরাহকৃত পণ্যের দামও বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অন্য গ্রুপগুলো চেষ্টা করে তার যে ব্যয় বৃদ্ধি হলো, তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় কি না। যেমন রিকশাওয়ালা তার রিকশা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। শ্রমিক তার মজুরি বাড়িয়ে নেন, বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন। এটাই এখন আমাদের দেশে হচ্ছে।’
সরকারি নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে ডলার সংকটকে দায়ী করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকার অবমূল্যায়ন ৪০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা বলা হলেও কোনো আমদানিকারকই এই দরে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলসিতে বেশি দামে ডলার কিনতে হয় এবং অতিরিক্ত দাম নগদে পরিশোধ করেন আমদানিকারকরা। দুই বছরের মধ্যে এখন সুদের হারও বেশি। আমদানি পণ্যের দাম বাড়াতে এটিও বড় ভূমিকা রাখছে। তবে এসব ছাপিয়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট এখন এতটাই শক্তিশালী যে উৎপাদন মৌসুমেও পেঁয়াজ তিন গুণের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এবার সব রেকর্ড ভেঙে শীতকালীন সবজিও উচ্চমূল্যে কিনতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন রোজায় খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে এমনটি ধরেই নিয়েছেন ভোক্তারা।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, ২০২২ সালে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৫ টাকার মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে সেই ডলারের সরকারি দাম ১১১ টাকা। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সেই ডলার কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা করে। সেই হিসাবে তিন বছরে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ায় তার প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে, ভোক্তাকে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। রোজায় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। যেন রোজায় মানুষের কষ্ট না হয়। যেখানে পণ্য সরবরাহে অনিয়ম পাচ্ছি, সেখানেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর জন্য ভোক্তার ভ্রাম্যমাণ টিম প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে থাকে।’
দ্য গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় বলা হয়, রমজানে ৮৩ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস পরিবর্তন করে। রমজানে খাদ্যের খরচ খাদ্যের বার্ষিক ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হয়।
বাঙালির ইফতারে সবচেয়ে পরিচিত খাবার ছোলা-মুড়ি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৩ মার্চ ছোলার দাম ছিল কেজিতে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকা, এবার তা ১১০ টাকার নিচে কেনা প্রায় অসম্ভব।
সংযমের সারা দিনের পর একটু তৃপ্তি আনে এক গ্লাস শরবত। তৃপ্তির ঢোক গিলতেও গুনতে হবে বেশি টাকা। চিনির কেজি গত বছরের মার্চে ছিল ১০৭ টাকা, সেটি এ বছর ১৪০ টাকা। ২০২২ সালে এই চিনির দাম ৭৪ টাকা ছিল; অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। শরবতের অন্যতম অনুষঙ্গ মাঝারি আকারের লেবুর হালি গত বছর ছিল সর্বোচ্চ ৪০ টাকা, এবার তা কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়।
ভাজাপোড়ায় বাঙালির আকর্ষণ সব সময়ই বেশি, রমজানে তো বাছবিচার ছাড়াই। বেগুনি ইফতারে কমবেশি সবার পাতেই থাকে। গত রমজানে বেগুনের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৫০ টাকা, এবার তা ৫০ থেকে ৭০ টাকার নিচে পাওয়া অসম্ভবই বলা চলে। দেশীয় ফল তরমুজ, কলা ইফতারে জনপ্রিয়। গত বছর যে কলা ২৫ থেকে ৩০ টাকা হালি কেনা যেত, সেটি এখন ৪০ টাকার নিচে নয়। এখন প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৫০ টাকার মধ্যে।
দেশীয় ফলের পাশাপাশি বাড়ছে আমদানি করা ফলের দামও। শুল্ক বাড়ার কারণে গত বছর থেকেই বিদেশি ফল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এবার দাম আরও বেড়েছে। আমদানি করা ফলের বাজারে যেন দামের আগুনে পুড়ছে মানুষ। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব ফলে গড়ে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে দেশি ফলের দামও। বর্তমান বাজারে আমদানি করা ফলের মধ্যে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। অথচ গত বছর এ সময় মাল্টার কেজি ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। মাল্টা ছাড়াও সবুজ আপেল কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে নাশপাতি কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। ১৯০ থেকে ২২০ টাকার কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৭০ টাকা।
সৌদি আরবের খেজুর মেডজুল, মাবরুম, আজওয়া ও মরিয়ম। এক মাসের ব্যবধানে এসব খেজুরের দাম কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে। জাম্বো মেডজুল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০, সাধারণ মেডজুল ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০, মাবরুম খেজুর ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ ও আজওয়া খেজুর মানভেদে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত বছরের তুলনায় তেলে কিছুটা স্বস্তি আছে, তবে দাম নাগালের মধ্যে নেই। গত বছর ব্র্যান্ডের এক লিটার তেলের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৮৭ টাকা, তবে এবার তা কিছুটা কমে ১৬০ টাকায় এসেছে। তবু মধ্যবিত্তের জন্য কষ্টই হবে তেল কিনতে।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যের বাড়তে থাকা দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে এক বছর ধরেই খাদ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। ‘খাদ্যনিরাপত্তা’ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। বিশ্বব্যাংক নিয়মিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হারের ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে চারটি শ্রেণিতে রেখেছে। বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাদ্যের মূল্যস্ফীতি শ্রেণিতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ হিসাবে (অক্টোবর-নভেম্বর) প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ভুটান ও নেপালে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম ছিল। অনেক বেশি ছিল পাকিস্তানে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়ে গেলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়।