সিলেটে অগ্নিদূর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জানেনা কেউ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ মার্চ ২০২৪, ১২:৩০:৩৮ অপরাহ্ন
রোববার থেকে মাসব্যাপী অভিযান : সিলেট ফায়ার সার্ভিস
এমজেএইচ জামিল : বেইলি রোড ট্র্যাজেডির মতো দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধু টনক নড়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। শুরু হয় তোড়জোড়। তদন্ত হয়, জমা পড়ে কিছু সুপারিশ। তালিকা ধরে চলে বিশ্লেষণ। এরপর নেমে আসে রহস্যময় নিরবতা! তবে সিলেটের চিত্র আরো হতাশার। সিলেটের ঝূঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই জানেনা কেউ।এ নিয়ে ফায়ার সার্ভিস, সিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করলে সিলেটের এ সংক্রান্ত কোন তালিকা নেই বলে দৈনিক জালালাবাদকে জানান তারা।
তবে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা ভবন, রেস্টুরেন্ট ও কলকারখানার তালিকা হালনাগাদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে সিলেটেও। সিলেটে আগামী রোববার (১০ মার্চ) থেকে অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভি এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। অভিযান চলবে এক মাসব্যাপী। অভিযানে ঝুঁকিপূর্ণ রেষ্টুরেন্ট, হাসপাতাল, মার্কেট, বিপনী-বিতান ও কারখানার তালিকা প্রস্তুত করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্যে কলকারখানাগুলোর কার্যক্রম চলছে। অনেক কারখানাতেই নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। তাদের অনেকে রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। পোশাক ও কেমিক্যাল কারখানা, ইলেকট্রনিকস, টেক্সটাইল মিল ও ঝুটের গুদামগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। গাজীপুরে ছোট-বড় প্রায় দুই হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ ভাগ কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। কারখানা ও ভবনগুলোর কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাশাপাশি লাখো কর্মী রয়েছেন মারাত্মক অগ্নিঝুঁকির মধ্যে। অনেক কারখানার মালিক ফায়ার লাইসেন্স নেওয়ার পর ফায়ার সেফটির দিকে আর নজর দেন না। আবার অনেক মালিক আইন মেনে ভবন তৈরি করেন না।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, সিলেটসহ সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে রেষ্টুরেন্ট-কারখানাসহ ২২৭৩টি প্রতিষ্ঠান অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার বালাই নেই। কোনো আইনেরই তোয়াক্কা করছে না এসব র্কর্তৃপক্ষ। ভবনগুলোতে নেই বিকল্প সিঁড়ি। নেই কোনো নজরদারি। যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। প্রতিষ্ঠান মালিকদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী হওয়ায় নেওয়া যাচ্ছে না শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াতে ইতিমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোতে গত রোববার থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। সিলেটসহ দেশের অন্যান্য জায়গায়ও শীঘ্রই একই ধরনের অভিযান শুরু হবে বলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেট নগরীতে রেস্টুরেন্ট-কলকারখানাসহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা আমাদের হাতে নেই। তাই এই মুহুর্তে সংখ্যাটা বলা যাচ্ছেনা। আমরা চাইলেও অভিযান চালাতে পারিনা। তবে সম্প্রতি রাজধানীর বেইলী রোড অগ্নিকা- ট্রাজেডীর পর অধিদপ্তর থেকে একটি দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনার আলোকে আমরা আগামী রোববার (১০ মার্চ) থেকে সিলেটে মাসব্যাপী অভিযানে নামতে যাচ্ছি। অভিযানে নগরীর রেষ্টুরেন্ট, হাসপাতাল, মার্কেট ও কলকারখানাসহ অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা হবে। সেই আলোকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিস্ফোরক পরিদপ্তর সিলেটের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক মোঃ মোজাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, রেস্টুরেন্ট-কলকারখানাসহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা আমরা করিনা। কারণ রেষ্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ অথবা সিলিণ্ডার জনিত কারণে দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। আর ভোক্তা পর্যায়ে সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের কাজ নেই। তবে যদি কোন রেষ্টুরেন্ট বা প্রতিষ্ঠান চাহিদার ১০টার বেশী সিলিন্ডার মজুত করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোঃ সাইফুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমাদের কাছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা সিলেটের রেষ্টুরেন্টসহ কোন প্রতিষ্ঠানের তালিকা নেই। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা এ সংক্রান্ত কোন নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফায়ার সার্ভিস বা সিসিক কেউ যদি অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইফতেখার আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ঢাকার বেইলী রোডের অগ্নিকাণ্ড ট্রাজেডী পরবর্তী সতর্কতার অবলম্বনের জন্য আমি আজ মঙ্গলবার বিকেলে মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। শীঘ্রই আমরা মেয়র মহোদয়ের সাথে পরামর্শ করে সিলেটের সকল রেষ্টুরেন্টসহ প্রতিষ্ঠান মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসবো। সিলিন্ডার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা পেতে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনাসমূহ সবাইকে অবহিত করা হবে।
সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, ফেনীসহ অন্তত ৪৫টি জেলায় ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারখানা, রেস্টুরেন্ট, হোটেলসহ কোনো স্থাপনায় যাতে আর কোনো অগ্নিকা-ের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। ওইসব বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেসব কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম নেই, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে। এমনকি প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঐ বৈঠকের আলোচনা যেসব বিষয় উঠে আসে, তার মধ্যে রয়েছে- রাজধানী ঢাকা-সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। বাইরে চাকচিক্য থাকলেও এসব রেস্টুরেন্টের ভেতরটা যেন মৃত্যুফাঁদ। আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁর অনুমোদন না থাকলেও নিয়ম ভেঙে ব্যাঙের ছাতার মতো রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে গড়ে উঠেছে কলকারখানা। জরাজীর্ণ ভবনে ছোট্ট সিঁড়িই আসা-যাওয়ার একমাত্র পথ। কোনো কোনো জায়গায় একমাত্র সেই পথও থাকছে তালাবদ্ধ। কাচঘেরা রেস্টুরেন্ট ভবনের সিঁড়িতে সিলিন্ডার রাখার নিয়ম না থাকলেও রাখা হচ্ছে অহরহ। এসব ভবনে বছরের পর বছর বৈদ্যুতিক লাইনগুলো পরীক্ষা করা হয় না। আবার সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নিয়মিত তদারকির কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন নামকাওয়াস্তে তদারকির নামে আসা-যাওয়া করলে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বারবার বলা হলেও মানা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। কোনো বড় দুর্ঘটনার পরপরই আমরা নড়েচড়ে বসি। মুনাফালোভী অপরাধীরা মানুষের জীবনের পরোয়া না করেই নিজেদের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও কলকারখানা গড়ে উঠেছে দেশের আনাচকানাচে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২৭৩টি কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম নেই বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের হিসাব নেই বললেই চলে। ইতিমধ্যে আমরা নির্দেশনা পেয়েছি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা, রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে যেতে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সব জেনেও ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অনেকেই নিয়মের মধ্যে চলে আসবেন। কোনো কারখানার অনুমোদন ও অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম আছে কি না তা মনিটরিং করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। আমরা শুধু শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করি। তার পরও আমরা রেষ্টুরেন্ট-কারখানাগুলোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’
অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম না থাকা কারখানা, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট র্কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এজন্য একটি তালিকা তৈরি করেছি। যারা আইন অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেইলি রোডের যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল সেখানে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিষ্ঠানটিকে আগে নোটিসও দেওয়া হয়েছিল।’