দেশে কেন কমছেনা মূল্যস্ফীতি?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০২৪, ৯:১৩:১০ অপরাহ্ন
কমেছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে
জালালাবাদ রিপোর্ট : অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতেও যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তা থেকে বেশিরভাগ দেশ বেরিয়ে আসলেও বাংলাদেশে এটি কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরো নানা বিষয় প্রভাব ফেলেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অর্থপাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা।
তারা বলছেন, দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতি জনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬৭ শতাংশে। জানুয়ারিতে এটি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এই উচ্চহার চলছে।
মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে বছর দুয়েক আগে বিশ্বের সাথে সাথে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে বাংলাদেশও একটি। তবে শুধু পাকিস্তান ছাড়া এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে কমেনি।
অন্যান্য দেশের যে অবস্থা :
বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে তুলে ধরা যায় শ্রীলঙ্কার নাম। বছর দুয়েক আগে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়লেও সেখান থেকে উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ৪৯ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই হার এসে দাঁড়ায় ৬.৩ শতাংশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।
অর্থনীতিকে চাঙা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে মুদ্রানীতি কঠোর করে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছে, সরকার কৃচ্ছতা সাধন করে বাজেট ঘাটতি কমিয়েছে, বার্ষিক ঘাটতি কমাতে ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে, ঋণ পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে দেশটি। একই সাথে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১.১ শতাংশ। সেটি কমে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ১৬ জানুয়ারি ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধান শক্তিকান্ত দাস বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে এই তথ্য দিয়েছেন। দেশটির মুদ্রানীতি কঠোর করার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানানো হয়।
নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ২০২৪ এর জানুয়ারিতে হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এটি ৮.১৯ শতাংশ ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভুটানের মূল্যস্ফীতি ৪.২ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরেও এটি ৫.০৭ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ যা যা করেছে :
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা ভোক্তা মূল্য সূচক বা সহজে বলতে গেলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৯.৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি এখনো সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি।
আইএমএফ এর ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। তার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুদ্রানীতিতে কঠোরতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে নীতি-সুদ হার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে আরো বেশি সুদ দিতে হবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে।
এছাড়া ডলারের দাম নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে করে ডলারের দাম অর্থনীতির সাথে মিল রেখে ওঠানামা করবে।
একই সাথে খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগে ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি’ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারের নির্ধারিত মাত্রার বিষয়টি তুলে নেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
নিত্য ব্যবহার্য অনেক পণ্য আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণে কিছু পণ্যের আমদানিরে ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এতোসব ব্যবস্থা নেয়ার পরও মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না।
সফল হয়নি কেন?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি না কমার পেছনে দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কিছু বাজার ভিত্তিক। আর কিছু রয়েছে বাজার বহির্ভূত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। যে পরিমাণ ডলার আয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ডলার দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। আর এর পেছনে স্বাভাবিক কোনো কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং অসাধু উপায়ে ডলার পাচারের কারণে এমনটা হচ্ছে। আর এটা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।
“দ্বিতীয়ত, উৎপাদক ও ভোক্তার দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এর কারণ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কয়েক হাত বদল এবং নানা ধরনের চাঁদাবাজি। অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হওয়ার কারণে চূড়ান্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে পণ্য সরবরাহের সুযোগ কুক্ষিগত থাকায় তারাই পণ্যের দাম নির্ধারণ করছে। ফলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা কাজ করছে না-এমনটাই বলেন এম এম আকাশ।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “কিছুদিন আগে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেছিলেন যে, এই সিন্ডিকেট হচ্ছে আমাদের সরকারের চেয়ে মোর পাওয়ারফুল। এটাকে আর দমন করতে পারছি না।” এ ধরনের কারণে বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বলে জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, উল্টোভাবে দেখতে গেলে শ্রীলঙ্কা খারাপ অবস্থানে থাকার পরও সেখানে এ ধরনের অনুঘটক না থাকার কারণে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
“শ্রীলঙ্কা আমদানি-রপ্তানি, ট্যুরিজম করে, ডলারটা নিজের দেশে এনে, ভারত থেকে বৈদেশিক সাহায্য এনে, যেমনে পারে ডলারের মানটাকে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে। সেখানে যে সিন্ডিকেট ছিল সেটা ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার কারণে ভেঙ্গে পড়েছে। সুশাসন কায়েম হওয়ার ফলে এ ধরনের সমস্যা কমে এসেছে। তুলনামূলক বিচারের একই সারমর্মে পৌঁছাবেন, বাংলাদেশে যে কারণগুলো সক্রিয় আছে, অন্যান্য দেশে সে কারণগুলো সক্রিয় নেই। সে কারণে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না।