গ্রাহকের পকেট কেটে বিপিসির মুনাফা ৪৫ হাজার কোটি টাকা!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মার্চ ২০২৪, ৯:১১:৩৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: লোকসানের অজুহাতে ২০১১ সালের মে থেকে ২০১৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে পৌনে দুই বছরে দেশে পাঁচবার বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকটা কমলেও ২০১৬ সালে দেশে তা নামমাত্র কমানো হয়। ফলে ৭ বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় মাঝে ১ বছর লোকসান করলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়। এতে গত অর্থবছর আবারও উচ্চ মুনাফা করেছে সংস্থাটি।
দেশে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় নানা সময় সমালোচনা হলেও তা গুরুত্ব দেয়নি সরকার। ফলে ৯ বছরের মধ্যে ৮ বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছর সংস্থাটি লোকসান গুনেছিল ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। এতে ৯ বছরে বিপিসির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরও মুনাফায় রয়েছে বিপিসি। এরপরও স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের নামে সম্প্রতি নামমাত্র কমানো হয়েছে তেলের দাম।
বিপিসির তথ্যমতে, ২০১১ সালে ৪ দফা বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। প্রথমবার ৬ মে সব ধরনের তেলের লিটারে ২ টাকা হারে বাড়ানো হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়ে ৪৬ টাকা, পেট্রোল ৭৬ টাকা ও অকটেন ৭৯ টাকা। ১৯ সেপ্টেম্বর তা আরও ৫ টাকা হারে বাড়ে। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৫১ টাকা, পেট্রোল ৮১ টাকা ও অকটেন ৮৪ টাকা। ১১ নভেম্বর ও ৩০ ডিসেম্বর এ দাম আরও ৫ টাকা করে মোট ১০ টাকা বাড়ে। এতে ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ হয় ৬১ টাকা, পেট্রোল ৯১ টাকা ও অকটেন ৯৬ টাকা।
২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি আরও ৫ টাকা করে বাড়ানো হয় সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। এতে ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ৬৮ টাকা, পেট্রোল ৯৬ টাকা ও অকটেন ৯৯ টাকা। এরপর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেতে শুরু করে। এর প্রভাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর বড় অঙ্কের মুনাফা হয় বিপিসির। সে অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফা ছিল ৪ হাজার ২১২ কোটি দুই লাখ টাকা। যদিও এর আগে টানা ৬ অর্থবছর লোকসান করেছিল বিপিসি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও কমায় পরের অর্থবছর বিপিসির মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী থাকায় সংস্থাটির মুনাফার ধারা অব্যাহত থাকে পরের অর্থবছরও। ওই অর্থবছর বিপিসির মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। তবে উচ্চ মুনাফার পরও জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় সমালোচনার মুখে ডিজেলের দাম লিটারে মাত্র ৩ টাকা হারে কমানো হয়েছিল। আর পেট্রোল ও অকটেন কমানো হয় ১০ টাকা করে। এতে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা।
এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমলেও দেশে তা আর কমেনি। ফলে বিপিসির মুনাফা বাড়তেই থাকে। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবার নি¤œমুখী হতে শুরু করে। এতে বিপিসির মুনাফা বাড়তে থাকে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করে ৫ হাজার ৬৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
২০২০ সালের মাঝামাঝি বিশ্ববাজারে তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে নামে। এর প্রভাবে ২০২০-২১ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯২ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান করে সংস্থাটি। ওই অর্থবছর লোকসান হয় ২ হাজার ৭০৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। লোকসানের অজুহাতে ২০২১ সালে ৪ নভেম্বর ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ৮০ টাকা। তবে পেট্রোল ও অকটেনের দাম অপরিবর্তিতই রাখা হয়।
যদিও ৯ মাস পরই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ওই সময় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা এবং পেট্রোল ৮৮ টাকা ও অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়। এতে ২০২২ সালের ৬ আগস্ট দেশে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১১৪ টাকা, পেট্রোল ১৩০ টাকা ও অকটেন ১৩৫ টাকা। অথচ ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নি¤œমুখী ছিল। এতে সমালোচনার মুখে অনেকটা বাধ্য হয়েই একই মাসে ২৯ তারিখ প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা হারে কমানো হয়। ফলে ২৯ আগস্ট প্রতি লিটার ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ১০৯ টাকা, পেট্রোল ১২৬ টাকা ও অকটেন ১৩০ টাকা।
এরপরও গত অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এদিকে গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত দেয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের শর্ত দেয় সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে সরকার। এতে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। নির্দেশনার আলোকে মার্চের জন্য জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর করা হয়েছে।ডিজেলের দাম কমানো হয়েছে মাত্র ৭৫ পয়সা। এছাড়া পেট্রোলের দাম তিন টাকা ও অকটেন চার টাকা কমানো হয়েছে। এতে এখন ডিজেল ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা, পেট্রোল ১২২ টাকা ও অকটেন ১২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এ দাম আরও কমানোর সুযোগ ছিল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার নামমাত্র দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান তেলের যা দাম সে অনুসারে দাম আরও কমা উচিত ছিল। বিপিসি এক্ষেত্রে কী পদ্ধতিতে হিসাব করেছে তা স্পষ্ট নয়। তবে বিপিসির আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন ছিল। দাম নির্ধারণের এ পরিস্থিতিতে তা আরও জোরালো হলো।