খেজুরের বাজারে অস্থিরতা চলছেই!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মার্চ ২০২৪, ৯:১৩:৫৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : দরজায় কড়া নাড়ছে রমজান। তবে এখনও অস্থির খেজুরের বাজার। একদিকে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, রোজায় খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতার করতে। অন্যদিকে খেজুরকে ‘বিলাসী পণ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ শুল্ক-কর আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু তথা ট্যারিফ ভ্যালু দ্বিগুণ করা হয়েছে।যদিও গত মাসে খেজুরের শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। তবে দ্বিগুণ অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর জন্য খেজুরের দাম তেমন একটা কমেনি।
তথ্যমতে, খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু দ্বিগুণ করায় ১০০ টাকা দরে খেজুর আমদানি করলেও তার দাম ২০০ টাকা ধরে শুল্ক-কর আরোপ করা হয়। আমদানি মূল্য আরও বেশি হলে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু আরও বেশি হয়। ফলে ১১০ টাকায় আমদানি করা খেজুরে শুল্ক-কর দিতে হয় ১৪০ টাকা। আর ১২০ টাকায় আমদানি করা খেজুরে শুল্ক-কর দিতে হয় ২১০ টাকা। অথচ গত অর্থবছর এ শুল্ক ছিল মাত্র ১০ টাকা
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে নিম্নমানের খেজুরটির দামও গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আমদানিকারদের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খেজুরের ক্রয়মূল্য কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু এর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (আমদানি মূল্য) ১২০ টাকা নির্ধারণ করে এই খেজুরের শুল্কায়ন করছে এনবিআর। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়েও খেজুরের দাম বাড়ছে।
আমদানিকারকদের ভাষ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত খেজুর আমদানিতে টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) ছিল ১০ শতাংশ। তখন সাধারণ মানের খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল টনপ্রতি ৫০০ ডলার। ফলে এই খেজুরে কেজিপ্রতি শুল্ক দিতে হত পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু দ্বিগুণ করার পাশাপাশি কাস্টমস ডিউটি (সিডি), রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) এবং ভ্যাট মিলে শুল্ক-কর ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
যদিও গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার খেজুর আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। তারপরও অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের কারণে খেজুরের দাম উচ্চই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কার্যকর হওয়ায় পিপি ব্যাগে আসা প্রতি কেজি খেজুরে পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সার পরিবর্তে ৬৪ টাকা ৪১ পয়সা, ড্রাই কন্টেইনারে কার্টনে আসা খেজুরে ১০ টাকা ৯৩ পয়সার পরিবর্তে ১৬৯ টাকা ৯৭ পয়সা, রিফার কন্টেইনারে আসা কার্টন খেজুরে ১০ টাকা ৯৩ পয়সার পরিবর্তে ২৭২ টাকা এবং রিটেইল প্যাকেটজাত খেজুরে ২১ টাকা ৮৪ পয়সার পরিবর্তে ১৮০ টাকা ৩৭ পয়সা শুল্ক দিতে হচ্ছে।
তথ্যমতে, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২৪ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। তবে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৮৮ হাজার ৫৬৭ দশমিক ৬৪ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছিল। আর ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছে ৬৮ হাজার ৫১৫ দশমিক ২৯ মেট্রিক টন।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী খেজুর আমদানি করতে পারছেন না। এর মধ্যে প্রকৃত মূল্যের চেয়েও বাড়তি দামে শুল্কায়ন খেজুরের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। যৌক্তিক অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাননি।
যদিও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের দামের ওপর ভিত্তি করে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বিদ্যমান অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুকে অযৌক্তিক দাবি করার সুযোগ নেই। রমজান ঘিরে যে পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে তার ৯৫ শতাংশ এরই মধ্যে খালাস হয়ে গেছে। আমদানি শুল্কও কমানো হয়েছে ১০ শতাংশ। তাই বাজারে অস্থিরতার কোনো সুযোগ নেই।
এ বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এক কনটেইনার খেজুর আমদানি করতে ৫০ লাখ টাকা শুল্ক দিতে হয়। আমদানি করা ১১০ টাকা কেজি দরের খেজুরে ১৪০ টাকা শুল্ক দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয় ২৫০ টাকায় এবং আমদানি করা ১২০ টাকা কেজি দরের খেজুরে ২১০ টাকা শুল্ক দিয়ে বাজারে ৩৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। এজন্যই বাজারে খেজুরের দাম বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই শুল্ক যুক্ত করা হয়েছে। অথচ গত বছর এক কেজি খেজুরে ১০ টাকা শুল্ক দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে আমি খেজুর আমদানি করি, কিন্তু কখনও এত শুল্ক দিতে হয়নি। আমি খেজুর আমদানি করলাম ৯০০ থেকে এক হাজার ডলারে। চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার সাধারণ কনটেইনার খেজুরের জন্য দুই হাজার ৫০০ ডলার এবং হিমায়িত কনেটেইনারের খেজুরের জন্য চার হাজার ডলার শুল্ক নির্ধারণ করেছে। এতে করে খেজুরের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে গেল। আমরা এনবিআরে কথা বলেছি, কিন্তু তারা কোনো যুক্তি দেখাতে পারল না-কেন এটার শুল্ক দুই হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার ডলার করল। এই অ্যাসেসমেন্টে এক কার্টন খেজুর আমাকে বিক্রি করতে হবে সাড়ে চার হাজার টাকায়, কেজি পড়বে ৪৫০ টাকা।’
প্রসঙ্গত, বাজারে সবচেয়ে কম দামি খেজুর জাহিদি জাতের। খেজুরটি প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ এই জাতের খেজুরের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া দাবাস খেজুর গত বছর বিক্রি হয়েছিল ২৮০ টাকা কেজি দরে, এখন তা বিক্রি হচ্ছে হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। বরই নামে পরিচিত খেজুর গত বছর প্রতি কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়।
আজওয়া, মাবরুম ও মরিয়ম জাতের খেজুরের দামও অনেক বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকায়, যা গত বছর ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। মাবরুম বিক্রি হচ্ছে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা। মরিয়ম বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায়, যা গত বছর ছিল ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। মেডজুল বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। আলজেরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৪০০ টাকা।